পাবনা জেলার সদরের গয়েশপুর ইউনিয়নের বাঙ্গাবাড়িয়া এলাকায় আজ সকালেই নেমে এসেছে এক ভয়াবহ শোকের ছায়া।
রবিবার (২৬ অক্টোবর ২০২৫) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা–পাবনা মহাসড়কে একটি মালবাহী ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্কুলগামী ভ্যানের ওপর উল্টে পড়ে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রাণ হারান তিনজন—এর মধ্যে ছিলেন দুই কোমলমতি স্কুল শিক্ষার্থী ও একজন ভ্যানচালক।
এই দুর্ঘটনা স্থানীয়দের মনে দগ্ধ ঘা হয়ে রইল। সকালবেলার পড়াশোনার প্রস্তুতি, ব্যাগ কাঁধে করে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ—সব কিছু এক মুহূর্তে থেমে গেল চিরতরে।
নিহতদের পরিচয়
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহতরা হলেন—
১️⃣ তাসমিয়া আক্তার (১০) — পাবনা কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী।
২️⃣ আবু তোহা (১১) — একই প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
৩️⃣ আকরাম হোসেন (৪৫) — স্থানীয় ভ্যানচালক, যিনি প্রতিদিন শিশুদের স্কুলে পৌঁছে দিতেন।
এরা তিনজনই ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাদের মৃত্যুতে পুরো এলাকাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া।
দুর্ঘটনার বিবরণ
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শিশুদের নিয়ে একটি ভ্যান পুষ্পপাড়া এলাকা থেকে জালালপুরের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা বাঁশবোঝাই একটি ভারী ট্রাক হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারায়।
আরেকটি গাড়িকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রাকটি ব্রেক কষলেও ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়ে ঠিক সেই ভ্যানের ওপর।
ভ্যানটি এক মুহূর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুই শিক্ষার্থী ও চালক আকরাম হোসেন।
এ সময় আশেপাশে থাকা কয়েকজন চা বিক্রেতা ও পথচারী আহত হন।
তাদের মধ্যে সদর উপজেলার মধুপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে সাদ হোসেন (৩০) গুরুতর আহত অবস্থায় পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
পুলিশের বক্তব্য
মাধপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান জানান—
“দুর্ঘটনায় তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন এবং দুজন আহত হয়েছেন। ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া চলছে।”
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাকটির ব্রেকফেল বা অতিরিক্ত বোঝা থাকার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়দের শোক ও ক্ষোভ
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যেই স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলে ভিড় করেন।
নিহত শিক্ষার্থীদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। অভিভাবক ও স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন—
“প্রতিদিন সকালেই এই রাস্তায় শিশুরা স্কুলে যায়। ট্রাকগুলো খুব বেপরোয়া চলে। পুলিশ থাকে না, চালকরাও গতি নিয়ন্ত্রণ করে না। আজ দুইটা ফুলের মতো শিশু আমাদের চোখের সামনে চলে গেল।”
আরেকজন স্থানীয় মহিলা জেসমিন আক্তার বলেন—
“তাসমিয়া আমার প্রতিবেশী ছিল। প্রতিদিন হাসিমুখে স্কুলে যেত। আজ তার নিথর দেহ দেখলাম, বিশ্বাস করতে পারছি না।”
ঢাকা–পাবনা মহাসড়ক: মৃত্যু ফাঁদে পরিণত
স্থানীয়রা জানায়, ঢাকা–পাবনা মহাসড়কটি দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সড়কের অনেক জায়গায় গর্ত, বাঁক ও ভাঙাচোরা অংশ থাকায় দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
গত ছয় মাসে এই মহাসড়কে অন্তত ১৩টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে—যেখানে ২৫ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে এলাকাবাসী বারবার মানববন্ধন করলেও স্থায়ী সমাধান আসেনি।
বিদ্যালয়ে শোক দিবস ঘোষণা
পাবনা কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম জানান—
“আমাদের দুই মেধাবী শিক্ষার্থীকে আমরা হারিয়েছি। পুরো স্কুল পরিবার শোকে স্তব্ধ। আগামী তিন দিন শ্রদ্ধা ও শোকের প্রতীক হিসেবে কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে এবং আজ ক্লাস স্থগিত রাখা হয়েছে।”
দাফন সম্পন্ন, প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি
দুপুরের পর নিহতদের মরদেহ পরিবারে হস্তান্তর করা হয়। বিকেলে জানাজা শেষে নিজ নিজ গ্রামের কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
পাবনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান—
“নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ জনের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
তবে বেসরকারি সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর তথ্য বলছে, প্রকৃত সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি।
২০২৪ সালে দেশে ৬,৭০০টির বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে ৮,৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন।
এর মধ্যে শিক্ষার্থী ও শিশুদের মৃত্যু হার বেড়েছে ১৭%।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তার অনিয়ন্ত্রিত গতি, লাইসেন্সবিহীন চালক, রাস্তায় ভারী যানবাহনের অবাধ চলাচল ও ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতাই এর মূল কারণ।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে নতুন করে আন্দোলনের ডাক
পাবনার এই দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফের উঠেছে নিরাপদ সড়কের দাবি।
ফেসবুক ও এক্স (টুইটার)–এ মানুষজন লিখছেন—
“আমরা আর শিশুদের লাশ দেখতে চাই না।”
“স্কুলগামী শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।”
স্থানীয় সংগঠন “পাবনা সেফ রোড মুভমেন্ট” সোমবার সকালে দুর্ঘটনাস্থলে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
পাবনার বাঙ্গাবাড়িয়ার এই দুর্ঘটনা কেবল তিনটি প্রাণের মৃত্যু নয়, এটি আমাদের সড়ক ব্যবস্থার করুণ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
দুই ফুলের মতো শিশুর প্রাণ হারানোর এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল—
“নিরাপদ সড়ক” এখন আর কেবল একটি দাবি নয়, এটি একটি জাতীয় প্রয়োজন।
MAH – 13476 I Signalbd.com



