আঞ্চলিক

দিনাজপুরে বার বার কাশি দিয়ে পরীক্ষার হলে ডিভাইসসহ ধরা পড়লেন চাকরিপ্রার্থী

Advertisement

‘প্রশ্নের সেট পদ্মা হলে দিতে হবে কাশি’—নির্দেশনা পেয়ে জালিয়াতির ফাঁদে পরীক্ষার্থী, অভিযান চালিয়ে আরও দুই শিক্ষক আটক

দিনাজপুরে খাদ্য অধিদপ্তরের ‘উপখাদ্য পরিদর্শক’ পদের লিখিত পরীক্ষায় জালিয়াতির চেষ্টাকালে এক চাকরিপ্রার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। বারবার কাশি দিয়ে প্রশ্নপত্রের সেট সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করায় তার প্রতি নজর পড়ে পরীক্ষক ও প্রশাসনের। পরে তল্লাশি চালিয়ে তার শরীরে লুকানো ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়।

পরীক্ষার হলে কাশি দিতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন চাকরিপ্রার্থী

শনিবার সকাল ১১টার দিকে দিনাজপুর শহরের কসবা এলাকার কেরী মেমোরিয়াল হাই স্কুল কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। আটক পরীক্ষার্থীর নাম কৃষ্ণকান্ত রায় (২৫)। তিনি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সিঙ্গুল পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আশুতোষ রায়ের ছেলে।

পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, পরীক্ষার শুরুতেই কৃষ্ণকান্ত সন্দেহজনকভাবে বারবার কাশি দিতে থাকেন। এতে পর্যবেক্ষণকারীদের সন্দেহ হলে তাঁকে তল্লাশি করা হয়। এ সময় তার শরীরের পোশাকের ভেতর থেকে একটি ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ডিভাইস উদ্ধার করা হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা গোপন তথ্য পেয়েছিলাম, কিছু পরীক্ষার্থী ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁসচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। পরে নির্দিষ্ট কক্ষে নজরদারি বাড়ানো হয়। কৃষ্ণকান্তের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে তল্লাশি চালিয়ে ডিভাইসসহ তাকে আটক করা হয়।”

“প্রশ্নের সেট পদ্মা হলে দিতে হবে কাশি”—জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য

আটকের পর কৃষ্ণকান্তকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, একটি চক্র তাকে পরীক্ষায় জালিয়াতির নির্দেশ দিয়েছিল। চক্রের সদস্যরা তাকে জানিয়েছিল—যদি প্রশ্নের সেট ‘পদ্মা’ হয়, তাহলে কাশি দিতে হবে, যাতে বাইরে থাকা সহযোগীরা সেট নম্বর বুঝে উত্তর পাঠাতে পারে।

কৃষ্ণকান্ত জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, “পরীক্ষা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রশ্নপত্রের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হতো চক্রের সদস্যদের কাছে। তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে ডিভাইসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিত।”

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পরীক্ষার আগে থেকেই এই চক্র শহরের ফকিরপাড়া ও সুইহারি এলাকার দুটি ছাত্রাবাসে অবস্থান করছিল। সেখানে কয়েকজন শিক্ষক ও কোচিং সেন্টার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রশ্ন সমাধানের কাজ করতেন।

ছাত্রাবাসে অভিযান, আরও দুই শিক্ষক গ্রেফতার

কৃষ্ণকান্তের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দিনাজপুর শহরের স্বপ্নচূড়া ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে পুলিশ আরও দুইজনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন মো. সবুজমামুনুর রশিদ মামুন। দুজনই স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে জানিয়েছে পুলিশ।

অভিযানে পাঁচটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস, একাধিক সিম কার্ড, নকল স্ট্যাম্প, বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ড ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষাসামগ্রী জব্দ করা হয়। পুলিশ ধারণা করছে, এটি একটি সুসংগঠিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্র, যারা দেশের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় একই কৌশলে জালিয়াতি চালিয়ে আসছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এস এম হাবিবুল হাসান বলেন, “পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য জেলা প্রশাসন কঠোর নজরদারি রেখেছিল। আমাদের সেই নজরদারির কারণেই জালিয়াতি চেষ্টাটি ধরা পড়ে। আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও বড় চক্রের তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছি।”

কীভাবে কাজ করত এই জালিয়াত চক্র

পুলিশ তদন্তে জানা গেছে, এই চক্র ঢাকায় বসে সারাদেশের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের চেষ্টা চালায়। পরীক্ষার্থীকে আগে থেকেই একটি ক্ষুদ্র ডিভাইস সরবরাহ করা হয়, যা সাধারণত শার্টের কলার বা বুকের কাছে লুকানো থাকে। পরীক্ষা শুরুর পর প্রশ্নপত্রের ছবি মোবাইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়।

এরপর চক্রের সদস্যরা সেট নম্বর বুঝে বাইরে থেকে ব্লুটুথ বা রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে উত্তর পাঠায়। পরীক্ষার্থী কানের ছোট ইয়ারপিসে উত্তর শুনে উত্তরপত্র পূরণ করে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নপত্রে সংকেত দেওয়ার জন্য কাশি, হাঁচি বা নির্দিষ্ট ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়, যাতে বাইরের সদস্যরা সেট চিহ্নিত করতে পারেন।

স্থানীয় প্রশাসন ও জনমতের প্রতিক্রিয়া

দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং একটি সংগঠিত অপরাধচক্রের অংশ। এই চক্র চাকরিপ্রার্থীদের প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।”

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই কোচিং সেন্টারগুলোর সন্দেহজনক কার্যকলাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাদের দাবি, “প্রতিটি বড় নিয়োগ পরীক্ষার আগে কিছু ছাত্রাবাসে অচেনা লোকজনের আনাগোনা বাড়ে, যা এখনই বন্ধ করা দরকার।”

অন্যদিকে, পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটক তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

পরীক্ষার নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জালিয়াতির ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় প্রশ্নফাঁস চক্র উচ্চপ্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা শনাক্ত করা কঠিন।

তারা মনে করেন, পরীক্ষাকেন্দ্রে ডিভাইস শনাক্তকারী স্ক্যানার ব্যবহার, পরীক্ষার সময় মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ এবং সন্দেহভাজন পরীক্ষার্থীর চলাফেরায় নজরদারি বাড়ানো জরুরি।

দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা সব কেন্দ্রেই আরও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুপারিশ করছি, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়।”

দিনাজপুরে বারবার কাশি দিয়ে ধরা পড়া পরীক্ষার্থীর ঘটনা আবারও প্রমাণ করল—প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতি দেশের নিয়োগ ব্যবস্থার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতায় চক্রের একাংশ ধরা পড়লেও পুরো চক্রটি এখনো সক্রিয় থাকতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ও পরীক্ষার্থীর নৈতিকতার ওপর জোর দিতে হবে, তাহলেই সুষ্ঠু নিয়োগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

এম আর এম – ১৯২৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button