প্রযুক্তি

লোহিত সাগরে মাইক্রোসফটের সাবমেরিন কেবল বিচ্ছিন্ন

Advertisement

ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট হলো বৈশ্বিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের মূলভিত্তি। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিনোদন, ক্লাউড কম্পিউটিং—সবকিছুই এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। আর এই ইন্টারনেট সংযোগের বড় অংশই পরিচালিত হয় সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত সাবমেরিন ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে। এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে ঘটেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

সৌদি আরবের জেদ্দা উপকূলের কাছে লোহিত সাগরের গভীরে অবস্থিত মাইক্রোসফটের ফাইবার অপটিক সাবমেরিন কেবল হঠাৎ করেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই কেবলগুলোর মাধ্যমে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যুক্ত থাকে হাই-স্পিড ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে। ফলে, এ দুর্ঘটনায় ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের ইন্টারনেট পরিষেবায় ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে কি?

মাইক্রোসফটের প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি মূলত মধ্যপ্রাচ্যে বেশি হয়েছে। এশিয়ার কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে ইউরোপ ও আমেরিকার সংযোগ তেমনভাবে প্রভাবিত হয়নি। কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দ্রুতই তারা জরুরি মেরামত কাজ শুরু করেছে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই পূর্ণ পরিষেবা স্বাভাবিক হবে।

মাইক্রোসফটের ক্লাউড পরিষেবা ‘অ্যাজুর’ ক্ষতিগ্রস্ত

এই সাবমেরিন কেবলটি শুধুমাত্র ইন্টারনেট ট্রাফিকের জন্য নয়, মাইক্রোসফটের জনপ্রিয় ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম ‘Azure’ পরিষেবার ডেটা ট্রান্সফারের জন্যও ব্যবহার করা হয়। অ্যাজুরে হাজারো কোম্পানি তাদের ডেটা সংরক্ষণ করে এবং অ্যাপ্লিকেশন চালায়। হঠাৎ করে কেবল বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে অ্যাজুর পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটে, যার ফলে ব্যাংকিং, ই-কমার্স, হেলথকেয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সমস্যা দেখা দেয়।

প্রশ্ন উঠেছে—এই দুর্ঘটনা কি শুধুই প্রযুক্তিগত? নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ?

হুতি বিদ্রোহীদের দায় স্বীকার

প্রাথমিকভাবে এই ঘটনাকে অনেকেই ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’ হিসেবে দেখলেও রবিবার হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে এর দায় স্বীকার করেছে। হুতি নিয়ন্ত্রিত আল মাসিরাহ টেলিভিশনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে শত্রুপক্ষকে দুর্বল করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।

এই ঘটনায় ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবমেরিন কেবল আক্রমণ একটি জটিল এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি কেবল স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

হুতি আক্রমণের পেছনে কারণ কী?

কেন হুতিরা এমন পদক্ষেপ নিল? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে গুপ্তচরবৃত্তি এবং হামাসের অবস্থান সনাক্ত করতে মাইক্রোসফটের ক্লাউড পরিষেবা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। যদিও মাইক্রোসফট এ অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এবং ইসরায়েলি কিছু সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নির্ভর নজরদারির জন্য এই ক্লাউড পরিষেবা ব্যবহার করা হয়। হুতিরা হয়তো সেই কারণেই কেবল আক্রমণ করেছে।

এটি কি প্রথম ঘটনা?

না। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ইয়েমেনের নির্বাসিত সরকার জানিয়েছিল, হুতিরা লোহিত সাগরে সাবমেরিন কেবল আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তখনও কয়েকটি কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তবে সেগুলোর দায় অস্বীকার করেছিল হুতিরা। এবার তারা প্রকাশ্যে দায় স্বীকার করায় পরিস্থিতি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

সাবমেরিন কেবল—বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের লাইফলাইন

বিশ্বে ৪৫০ টিরও বেশি সক্রিয় সাবমেরিন কেবল রয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ লাখ কিলোমিটার। এই কেবলগুলো পৃথিবীর ৯৯% আন্তর্জাতিক ডেটা ট্রাফিক বহন করে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট থাকলেও এর ক্ষমতা খুব সীমিত এবং ব্যয়বহুল। তাই সাবমেরিন কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর প্রভাব ভয়াবহ হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে থাকা ইন্টারনেট অবকাঠামোর নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।

অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক প্রভাব

ইন্টারনেট পরিষেবার বিঘ্নতায় ব্যাংকিং লেনদেন, অনলাইন শপিং, স্ট্রিমিং পরিষেবা, ভিডিও কনফারেন্স, অফিসিয়াল কাজকর্ম—সবকিছুই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে।

মেরামতের চ্যালেঞ্জ

সাবমেরিন কেবল মেরামত একটি জটিল প্রক্রিয়া। সাধারণত বিশেষায়িত শিপিং ভেসেল কেবলগুলো চিহ্নিত করে তুলে আনে, তারপর নতুন কেবল জোড়া দিয়ে পুনঃসংযোগ করা হয়। আবহাওয়া, গভীর সমুদ্রের স্রোত ও যুদ্ধ পরিস্থিতি মেরামতের সময় বাড়িয়ে দেয়।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ: ভবিষ্যতের জন্য হুমকি

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি ভবিষ্যতের যুদ্ধের নতুন রূপ। শুধু সাইবার হামলা নয়, এখন ফিজিক্যাল অবকাঠামোতেও আঘাত হানছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর ফলে বৈশ্বিক ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে।

গ্লোবাল প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর জাতিসংঘ, ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (ITU) এবং বিভিন্ন সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, সাবমেরিন কেবলগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।

লোহিত সাগরে মাইক্রোসফটের ফাইবার অপটিক সাবমেরিন কেবল বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা শুধু একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর জন্য এক বড় হুমকি। ভবিষ্যতে এমন আক্রমণ ঠেকাতে আরও উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

MAH – 12687,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button