আঞ্চলিক

শেরপুরে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ

Advertisement

“কৃষিই সমৃদ্ধি” শ্লোগানে রবি মৌসুমে উৎপাদন বাড়াতে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা কর্মসূচি

বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় “কৃষিই সমৃদ্ধি” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের রবি মৌসুমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকারের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যাতে রবি মৌসুমে গম, সরিষা, মসুর, চিনাবাদাম, খেসারি, অড়হর ও শীতকালীন পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

সরকারের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি: কৃষকের হাতে নতুন আশার আলো

বাংলাদেশ সরকার কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমাতে ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে দীর্ঘদিন ধরে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে।
এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো—

  • কৃষকদের মাঝে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ বিতরণ,
  • সার ব্যবহারে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান,
  • এবং রবি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

এই ধারাবাহিকতায় শেরপুর উপজেলায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ২১০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে।

অনুষ্ঠান আয়োজন ও প্রধান অতিথির বক্তব্য

২৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ বীজ ও সার বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যেখানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা কৃষি অফিসার ফারজানা আক্তার

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম। তিনি বলেন—

“সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করা হচ্ছে। বীজ ও সার শুধু একটি সহায়তা নয়, এটি একটি আত্মনির্ভরশীল কৃষির ভিত্তি।”

উপস্থিত অতিথিবৃন্দ

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—

  • উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নিয়ায কাজমীর রহমান,
  • উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও কৃষি পুনর্বাসন কমিটির সদস্য শারমিন আক্তার,
  • কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার হাবিবা আক্তারমো. জুলফিকার হায়দার,
  • এবং কৃষক প্রতিনিধি আজিজুল হক, যিনি কৃষকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

কৃষকদের অনুভূতি ও প্রত্যাশা

বীজ ও সার গ্রহণ করতে আসা কৃষক আজিজুল হক বলেন—

“বর্তমানে সার, বীজ ও কীটনাশকের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সরকার যদি এভাবে সহযোগিতা চালিয়ে যায়, তাহলে আমরা আবার আগের মতো জমিতে সব ফসল ফলাতে পারব।”

আরেক কৃষক রহিম উদ্দিন জানান, প্রণোদনার বীজের মান ভালো হলে তা থেকে উৎপাদনও ভালো হয়। “আমরা চাই এই ধরনের সহায়তা নিয়মিত হোক, যাতে কৃষকরা ঋণের ফাঁদে না পড়ে,” বলেন তিনি।

কৃষি বিভাগের পরিকল্পনা ও টার্গেট

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এই রবি মৌসুমে শেরপুরে মোট ৩ হাজার ২১০ জন কৃষককে প্রণোদনা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—

  • গম বীজ : ১,২০০ কৃষক,
  • সরিষা বীজ : ৮০০ কৃষক,
  • মসুর : ৫০০ কৃষক,
  • খেসারি ও অড়হর : ৪০০ কৃষক,
  • এবং পেঁয়াজ ও চিনাবাদাম বীজ : ৩১০ কৃষক।

প্রতিটি কৃষককে নির্ধারিত পরিমাণ বীজ ও রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে, যা প্রায় এক বিঘা জমির জন্য যথেষ্ট

কৃষি অফিসার ফারজানা আক্তার বলেন—

“আমরা চাই প্রতিটি কৃষক যেন তার জমি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেন। এজন্য সঠিক বীজ ও সার ব্যবহারের পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে নিয়মিত তদারকি করা হবে।”

রবি মৌসুমের গুরুত্ব

রবি মৌসুম (অক্টোবর থেকে মার্চ) বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় গম, সরিষা, মসুর, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা ফসল উৎপাদিত হয়, যা দেশের খাদ্য ও তেলবীজের চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখে

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খরার সময় বৃদ্ধি পাওয়ায় রবি মৌসুমের ফসল এখন আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। তাই সরকারের এ ধরনের সহায়তা শুধু প্রণোদনা নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার

বর্তমান সরকার কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
শেরপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানিয়েছে, স্থানীয় কৃষকদের ড্রিপ ইরিগেশন, উন্নত বীজ সংরক্ষণ প্রযুক্তি, মাটির উর্বরতা পরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

ফারজানা আক্তার বলেন,

“শুধু বীজ ও সার দিলেই হবে না, কৃষকদের প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ করে তোলার দিকেও আমরা সমান গুরুত্ব দিচ্ছি।”

কৃষকদের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন,

“বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কৃষির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।”

এই নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় সারা দেশে প্রায় এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে ধাপে ধাপে বীজ, সার ও প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করছে।

শেরপুরেও তার ব্যতিক্রম নয়। এ অঞ্চলে প্রতি মৌসুমেই প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় নতুন কৃষক তালিকাভুক্ত করা হয়, যাতে কেউ বাদ না পড়ে।

চাষাবাদে সেচ ও জলসংকট সমস্যা

স্থানীয় কৃষকরা জানান, বীজ ও সার পেলেও অনেক সময় সেচের খরচ বহন করা কঠিন হয়ে যায়। সেচযন্ত্রে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি কৃষকদের চিন্তায় ফেলেছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার ইতোমধ্যে সোলার পাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা আগামী মৌসুমে অনেক কৃষককে সহায়তা দেবে।

পরিবেশবান্ধব কৃষি ও টেকসই উন্নয়ন

বিশ্বজুড়ে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে টেকসই কৃষিতে—যেখানে রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করে জৈব সার ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয়।
শেরপুরের কৃষি বিভাগও কৃষকদের জৈব সার ব্যবহার, ফসলের ঘন ঘন রোটেশন ও জৈব কীটনাশক প্রয়োগ বিষয়ে সচেতন করছে।

প্রণোদনার প্রভাব: স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক সাড়া

শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির ফলে স্থানীয় কৃষি উৎপাদনে ১৫-২০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে, যা স্থানীয় বাজারে পণ্য সরবরাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কৃষি কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা

উপজেলা কৃষি অফিসার ফারজানা আক্তার বলেন—

“আমাদের প্রত্যাশা, এই বছরের প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকরা আগের চেয়ে বেশি জমিতে রবি ফসল চাষ করবে। এতে একদিকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে কৃষকের আয়ও বাড়বে।”

তিনি আরও জানান, কৃষকদের পাশে থেকে মাঠপর্যায়ে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হবে, যাতে তারা চাষাবাদে কোনো সমস্যায় না পড়েন।

রবি মৌসুমের এ প্রণোদনা কর্মসূচি শেরপুরের কৃষকদের জীবনে নতুন প্রেরণা যোগাবে—এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
“কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে”—এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাস রেখে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন কৃষির উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

MAH – 13444 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button