
মুখবন্ধ: উৎসবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার!
পূজা মানেই উৎসব, আনন্দ আর আলোর রোশনাই। কিন্তু খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় সেই উৎসবের আলো নিভে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনায়। শ্যামাপূজা দেখতে গিয়ে এক উপজাতি কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ঘটনা শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি আমাদের সমাজের নিরাপত্তা এবং উৎসবে নারীদের সুরক্ষার প্রশ্নটিকে আবারও সামনে এনেছে। পাহাড়ি জনপদের সরলতা যেন আজ দুর্বৃত্তের লোলুপ দৃষ্টিতে কলুষিত হলো।
ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার (২০ অক্টোবর) গভীর রাতে। মাটিরাঙা সদর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের রামগড় সীমান্ত সড়কের ধলীয়া ব্রিজ সংলগ্ন একটি নির্জন বাগানে এই পাশবিকতা চালানো হয়। স্থানীয়দের দ্রুত সহায়তায় পুলিশ ইতোমধ্যে দুই অভিযুক্তকে আটক করেছে, তবে আরও দুজন পলাতক থাকায় জনমনে ক্ষোভ ও উদ্বেগ বিরাজ করছে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ: নৃশংসতার প্রতিচ্ছবি
মামলার এজাহার এবং পুলিশ সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি সদর থেকে ওই কিশোরী তার খালাতো বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল মাটিরাঙার বেলছড়ি ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়ায়। ধর্মীয় আবেগ ও উৎসবের টানে সেদিন রাতে সে স্বজনদের সঙ্গে বেলছড়ি ইউনিয়নের অযুদ্ধা কালী মন্দিরে শ্যামাপূজা দেখতে যায়।
মন্দিরের পবিত্র পরিবেশের বিপরীতে, সেখানে ওঁত পেতে ছিল চারজন দুষ্কৃতকারী। পূজা দেখতে যাওয়ার সময় থেকেই আসামিরা তার পিছু নেয়। সুযোগ বুঝে, প্রলোভন দেখিয়ে বা জোরপূর্বক মন্দির এলাকা থেকে কিছু দূরে নির্জন স্থানে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে রনি বিকাশ ত্রিপুরা ও সুমন বিকাশ ত্রিপুরা (পলাতক) পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। এরপর অপর দুই অভিযুক্তও ধর্ষণের চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ। এই পাশবিকতার ফলস্বরূপ, কিশোরীটি এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়ে। বিবেকহীন অপরাধীরা তাকে সেখানেই জঙ্গলে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
উদ্ধার ও আইনি পদক্ষেপ
পরদিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) দিবাগত রাত প্রায় ১টার দিকে ধলীয়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে অত্যন্ত অসুস্থ ও মুমূর্ষু অবস্থায় কিশোরীটিকে উদ্ধার করা হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে পরিবার ও স্বজনরা ছুটে আসেন।
প্রাথমিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে একটি সালিশ ডাকার চেষ্টা করা হয়। এই সালিশেই উপস্থিত হয় অভিযুক্তদের মধ্যে রনি বিকাশ ত্রিপুরা ও ডেটল বাবু ত্রিপুরা। স্থানীয় সচেতন জনতা সুযোগ বুঝে তাদের দু’জনকে আটক করে এবং কালক্ষেপণ না করে মাটিরাঙা থানায় খবর দেয়।
মাটিরাঙা থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আটক দুজনকে হেফাজতে নেয়।
আটককৃতরা হলেন: ১. রনি বিকাশ ত্রিপুরা (৩২), পিতা: অরুণ বিকাশ রোয়াজা, গ্রাম: চোংরাকাপা, বেলছড়ি ইউনিয়ন। ২. ডেটল বাবু ত্রিপুরা (১৭), পিতা: অনিরঞ্জন ত্রিপুরা, গ্রাম: বান্দরছড়া, গোমতী ইউনিয়ন।
আরও দুইজন অভিযুক্ত, যাদের মধ্যে সুমন বিকাশ ত্রিপুরাও রয়েছে, তারা এখনও পলাতক রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য ও চলমান অভিযান
মাটিরাঙা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌফিকুল ইসলাম ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করে সিগনালবিডি.কমকে জানান, “ধর্ষিতার বোন বাদী হয়ে মোট চারজনকে আসামি করে একটি সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করেছেন। স্থানীয়দের সক্রিয় সহায়তায় আমরা দ্রুত দু’জন অভিযুক্তকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি পলাতক আসামিদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনার জন্য আমাদের একাধিক বিশেষ দল কাজ করছে। বিভিন্ন সম্ভাব্য স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।”
ওসি আরও জানান, ভুক্তভোগী কিশোরীটিকে উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং তার ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। পুলিশ এই জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না।
পাহাড়ে নারী নিরাপত্তার প্রশ্ন
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবন সাধারণত সরল ও শান্ত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে নারী ও শিশুদের উপর যৌন হয়রানি এবং সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এই ঘটনাটি আবারও পাহাড়ে বসবাসরত নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। উৎসবের সময়েও যদি এমন নিরাপত্তাহীনতা দেখা যায়, তবে সাধারণ সময়ে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক অবক্ষয়, দ্রুত নগরায়ন ও মাদকাসক্তি অনেকাংশে দায়ী। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সমাজপতিদের আরও সচেতন ও কঠোর ভূমিকা পালন করা জরুরি।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: ক্ষোভ ও দাবি
এই পাশবিক ঘটনায় মাটিরাঙার স্থানীয় উপজাতি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সমাজকর্মী প্রীতিময় চাকমা (ছদ্মনাম) সিগনালবিডিকে জানান, “পূজার আনন্দ মুহূর্তে এভাবে মাটি হয়ে গেল। আমরা এই বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানাই এবং দ্রুততম সময়ে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এই ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং পুলিশ প্রশাসনকে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
আইনি প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যত পদক্ষেপ
ধর্ষণের মামলা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুতর প্রকৃতির অপরাধ। আইন অনুযায়ী, পুলিশ মামলাটি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করবে। আটককৃতদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং রিমান্ডে নিয়ে আরও তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা চালানো হবে। পলাতক আসামিদের ধরতে সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এই ধরনের মামলায় দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে ভুক্তভোগী দ্রুত ন্যায়বিচার পান এবং সমাজে অপরাধীদের জন্য একটি সুস্পষ্ট বার্তা যায় যে, এমন জঘন্য কাজ করে কেউ পার পাবে না।
মাটিরাঙার এই ঘটনা কেবল একটি সংবাদ নয়, এটি আমাদের সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি। উৎসবে আলোর মাঝে যে অন্ধকার লুকিয়ে ছিল, সেই অন্ধকারকে দূর করতে হলে কেবল আইনি ব্যবস্থার কঠোরতা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধের জাগরণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সিগনালবিডি.কম এই ঘটনার উপর নজর রাখছে এবং দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে।
MAH – 13440 I Signalbd.com