
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে ৩ লাখ এনভিডিয়া এইচ২০ চিপ সরবরাহ, তৈরি হবে তাইওয়ানের টিএসএমসিতে
বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে এক মহাসংকটের মাঝেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চিপের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চীনের বাজারে এই চাহিদা আশ্চর্যজনকভাবে বেড়েছে। সেই চাহিদা মেটাতে মার্কিন সংস্থা এনভিডিয়া ৩ লাখ এইচ২০ সিরিজের এআই চিপ তৈরির জন্য তাইওয়ানের বৃহত্তম চিপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান টিএসএমসি (TSMC)-কে অর্ডার দিয়েছে।
রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এই অর্ডার এনভিডিয়ার পক্ষ থেকে চীনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এইচ২০ চিপের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ। তবে মার্কিন সরকারের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে এ বিষয়ে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আর ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি বদল
২০২৩ সালের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রযুক্তি প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করতে কঠোর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তখন এনভিডিয়াকে বাধ্য করা হয়েছিল চীনের বাজারের জন্য একটি আলাদা, কম শক্তিশালী এইচ২০ চিপ তৈরির জন্য, যা এইচ১০০ বা ব্ল্যাকওয়েল সিরিজের চিপের থেকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনকে অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখা হয়।
তবে চলতি জুলাই মাসে ট্রাম্প প্রশাসন আবারও অনুমতি দিয়েছে এইচ২০ গ্রাফিক্স চিপ চীনে বিক্রির। এই সিদ্ধান্তটি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য দর-কষাকষির অংশ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে দুর্লভ খনিজ উপাদান রপ্তানিতে চীনের একতরফা নিষেধাজ্ঞার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র এই পিছু হঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
টিএসএমসির ৩ লাখ ইউনিটের নতুন অর্ডার, এনভিডিয়ার স্টক মজুত এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সূত্রের বরাতে জানা গেছে, নতুন অর্ডারের মাধ্যমে এনভিডিয়া বর্তমানে মজুত থাকা প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ ইউনিটের পাশাপাশি নতুন করে উৎপাদন শুরু করতে আগ্রহী। তবে চাহিদার ওপর ভিত্তি করে উৎপাদন পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেবে তারা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেমিঅ্যানালাইসিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এনভিডিয়া প্রায় ১০ লাখ এইচ২০ চিপ বিক্রি করেছে, যার একাংশই চীনে সরবরাহ করা হয়েছে।
এনভিডিয়ার সিইও জেনসেন হুয়াং গত মাসে বেইজিং সফরে গিয়ে বলেছিলেন, চাহিদা এবং অর্ডারের পরিমাণই হবে উৎপাদন পরিকল্পনার নির্ধারক। উৎপাদন শুরু হলে সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্গঠনে প্রায় ৯ মাস সময় লাগতে পারে।
লাইসেন্স সংকট ও মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের অবস্থান
চীনে এইচ২০ চিপ পাঠাতে মার্কিন সরকারের বিশেষ রপ্তানি লাইসেন্স দরকার। জুলাইয়ের মাঝামাঝি এনভিডিয়া আশ্বস্ত হয়েছিল যে শিগগির লাইসেন্স মঞ্জুর হবে, তবে সর্বশেষ জানা গেছে বাণিজ্য বিভাগ এখনো অনুমোদন দেয়নি।
এনভিডিয়া ও টিএসএমসি উভয়েই এই অর্ডার ও লাইসেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত রয়েছে। মার্কিন বাণিজ্য বিভাগও এই বিষয়ে প্রকাশ্য কোনো বক্তব্য দেয়নি।
চীনে এআই চিপসেটের চাহিদা ও বাজার পরিস্থিতি
বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি বাজার চীনে, টেনসেন্ট, বাইটড্যান্স, আলিবাবাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এইচ২০ চিপ দিয়ে তাদের এআই মডেল চালাতে আগ্রহী। নিষেধাজ্ঞার আগে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ চিপ অর্ডার করেছিল।
চোরাই পথে পৌঁছে যাওয়া উন্নত চিপ যেমন এইচ১০০-এর মেরামতের চাহিদাও বেড়েছে, যা এনভিডিয়ার জনপ্রিয়তা বজায় রাখার ইঙ্গিত দেয়।
মার্কিন আইনপ্রণেতাদের দ্বিদলীয় সমালোচনা ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
এইচ২০ চিপের চীনে সরবরাহ পুনরায় চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত মার্কিন কংগ্রেসের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলেই সমালোচিত হয়েছে। আইনপ্রণেতারা আশঙ্কা করছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের এআই প্রযুক্তির অগ্রাধিকার হ্রাস করতে পারে এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
আর্থিক প্রভাব: এনভিডিয়ার ক্ষতি ও সম্ভাব্য বাজার
নিষেধাজ্ঞার কারণে এনভিডিয়াকে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাতিল করতে হয়েছে। এনভিডিয়ার সিইও হুয়াং জানান, এই পরিস্থিতিতে কোম্পানি প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হারিয়েছে।
তবে বর্তমান বাজার চাহিদা ও নতুন অর্ডারের ভিত্তিতে এনভিডিয়া আবারও চীনে সরবরাহ বাড়ানোর সম্ভাবনা যাচাই করছে।
বাণিজ্য আলোচনার প্রেক্ষাপট: যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাম্প্রতিক আলোচনা
গত ২৮ জুলাই, স্টকহোমে মার্কিন ও চীনা প্রতিনিধিদল ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বাণিজ্য বিষয়ক আলোচনা করেছে। এই আলোচনায় চীনে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ও প্রযুক্তি সরবরাহ নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল।
চীনের প্রযুক্তি বাজারে মার্কিন এবং তাইওয়ানের ভূমিকা
বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি বাজার চীনে এআই চিপসেটের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ মার্কিন-তাইওয়ানের জটিল সম্পর্কের মাঝে বেঁধে দিয়েছে নতুন এক অধ্যায়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও টিএসএমসির মতো প্রতিষ্ঠান চীনের বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছে।
এনভিডিয়ার এইচ২০ চিপসেট নতুন করে চীনের বাজারে প্রবেশ করলে প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান নতুন করে আলোচনার বিষয় হবে।
MAH – 12018, Signalbd.com