আঞ্চলিক

লাশবাহী স্পিডবোটে ফিরল প্রবাসীদের নিথর দেহ, সন্দ্বীপবাসীর শোকের ছায়া

Advertisement

সন্দ্বীপে নতুন চালু হওয়া লাশবাহী স্পিডবোটের প্রথম যাত্রী হয়ে দেশে ফিরলেন প্রবাসী মোহাম্মদ আমীনসহ সাত প্রবাসী। মৃত্যুর এই করুণ পরিণতি পুরো দ্বীপবাসীর হৃদয়ে শোকের ছায়া নেমেছে।

স্পিডবোটে প্রথম যাত্রী প্রবাসী মোহাম্মদ আমীন

মাত্র ১০ দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাশবাহী স্পিডবোট চালুর খবর শেয়ার করে স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন প্রবাসী মোহাম্মদ আমীন। তিনি লিখেছিলেন, ‘অবশেষে দ্বীপবাসীদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে’। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—দশ দিনের মাথায় সেই স্পিডবোটেই নিথর দেহ হয়ে ফিরে এলেন তিনি নিজেই।
রোববার (১৯ অক্টোবর) সন্দ্বীপে নতুন চালু হওয়া লাশবাহী স্পিডবোটটির প্রথম যাত্রী হিসেবে মোহাম্মদ আমীনের লাশ দেশে আসে। তিনি সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আলী কব্বরের ছেলে। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন।

দুর্ঘটনায় নিহত অন্যান্য প্রবাসীরা

নিহত প্রবাসীদের মধ্যে আরও রয়েছেন—সারিকাইতের আমিন মাঝি, মো. আরজু, মো. রকি, সাহাব উদ্দিন ও মো. বাবলু এবং মাইটভাঙার মো. জুয়েল ও রহমতপুরের মো. রনি। তারা সবাই ওমানের ধুকুম সিদ্দা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
স্থানীয়রা বলছেন, ‘এই দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের শোক নয়, পুরো দ্বীপবাসীর হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে লাশবাহী যানবাহনের অভাবে মৃতদেহ পরিবহনে তারা সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়েছে। সেই কষ্ট লাঘবের প্রতিশ্রুতি নিয়ে চালু হয়েছিল এই স্পিডবোট। কে জানতো, প্রবাসী আমীনের নিথর দেহ প্রথম ফিরবে এই লাশবাহী স্পিডবোটে।’

দেশে লাশ আগমনের বিবরণ

নিহত প্রবাসীদের লাশ শনিবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। রোববার সকালে পূর্বনির্ধারিত জানাজার পর তাদের নিজ নিজ গ্রামে দাফন সম্পন্ন হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রবাসীরা সাগরে মাছ শিকার শেষে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। তাদের দেহগুলো দেশে ফেরার পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

দ্বীপবাসীর শোক ও প্রতিক্রিয়া

স্থানীয়রা জানান, এমন করুণ দৃশ্য তারা আগে কখনো দেখেনি। সাত প্রবাসীর লাশ একসঙ্গে দেখে স্বজনদের বিলাপ, আর্তনাদ এবং এলাকার মানুষের চোখের জল থামাতে পারেননি।
মুছাপুর ইউনিয়নের আবদুল হাই (৭২) বলেন, ‘নিহতরা আমার স্বজন নয়, কিন্তু তারা আমার সন্তান। সাত কফিনে সাতটি লাশ—এমন দৃশ্য আর কখনো দেখতে চাই না।’ নিহত সাহাব উদ্দিনের পিতা মো. সিদ্দিক জানান, ‘আমার জীবন শেষ হলেও, আমার চার মাস বয়সী মেয়ের কী হবে—এমন চিন্তায় মন ভেঙে যাচ্ছে।’

লাশবাহী স্পিডবোটের প্রয়োজনীয়তা

দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপে লাশবাহী যানবাহনের অভাবে মৃতদেহ পরিবহনে দ্বীপবাসীরা সীমাহীন কষ্ট পোহাতে বাধ্য ছিলেন। নতুন এই স্পিডবোট চালু হওয়ার ফলে স্থানীয়দের আশা ছিল, অন্তত মৃতদেহ দ্রুত এবং নিরাপদে পরিবারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু প্রথম যাত্রাতেই এই করুণ পরিণতি পুরো দ্বীপবাসীর হৃদয়কে শোকমগ্ন করেছে।

প্রবাসী ও পরিবারের প্রতিক্রিয়া

মোহাম্মদ আমীনের স্ত্রী এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রবাসী জীবনে অর্জিত অর্থের মাধ্যমে সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করার স্বপ্ন ছিল। অন্য নিহত প্রবাসীরাও অসচ্ছল পরিবারের সদস্য ছিলেন, যেখানে অনেকেরই চার থেকে ছয় মাস বয়সী সন্তান রয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষণ

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রবাসীদের নিরাপত্তা ও মৃত্যুর পর মরদেহ দ্রুত দেশে পৌঁছানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বীপের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে লাশবাহী যানবাহনের অভাব এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি স্থানীয়দের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাসী প্রেরণার ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সন্দ্বীপে লাশবাহী স্পিডবোট চালু হওয়ার করুণ প্রথম যাত্রা প্রমাণ করল, মানবিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের গুরুত্ব। মৃতদেহের নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও প্রবাসী সংগঠনগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য।
এবারের দুর্ঘটনা কেবল একটি পরিবারের নয়, পুরো দ্বীপবাসীর জন্য শোকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের করুণ ঘটনা যাতে পুনরায় না ঘটে, সে জন্য সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়াই একমাত্র পথ।

এম আর এম – ১৮৪৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button