
২০০৯ সালের পিলখানা ট্র্যাজেডির মামলায় কারাভোগ শেষে অবশেষে মুক্তি পেলেন বিডিআরের সাবেক ৯ সদস্য। বুধবার (১৫ অক্টোবর) দুপুরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি দেওয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আরও ৪ জনের জামিনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চলছে, যাচাই সম্পন্ন হলে তারাও মুক্তি পাবেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার আল মামুন বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে আদালত থেকে প্রাপ্ত জামিনের কাগজপত্র কারাগারে এসে পৌঁছায়। সব দাপ্তরিক যাচাই শেষে বুধবার দুপুরে ওই ৯ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার প্রেক্ষাপট
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত হয় বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত ওই বিদ্রোহে নিহত হন সেনাবাহিনীর বহু কর্মকর্তা, সৈনিক এবং বেসামরিক ব্যক্তি। ঘটনাটি দেশের রাজনীতি, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
ঘটনার পর সরকার একাধিক মামলা করে। এর মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও হত্যা মামলা দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দীর্ঘ তদন্ত, সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিচার শেষে অনেক আসামি সাজা পান, কেউ মৃত্যুদণ্ড, কেউ যাবজ্জীবন, আর কেউ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। সেই মামলারই বিস্ফোরক আইনের আওতায় দণ্ডিত ছিলেন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই ৯ জন সাবেক বিডিআর সদস্য।
কারাগার সূত্রে জানা তথ্য
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে আদালত থেকে আসা জামিনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ রাতেই শুরু হয়। যাচাই প্রক্রিয়ায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর বুধবার দুপুরে ৯ জনের মুক্তি কার্যকর করা হয়।
জেল সুপার আল মামুন বলেন, “আজ আমরা ৯ জন সাবেক বিডিআর সদস্যকে মুক্তি দিয়েছি। আদালত থেকে তাদের জামিনের কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই শেষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরও ৪ জনের জামিনের কাগজপত্র কারাগারে এসে পৌঁছেছে, সেগুলো যাচাই চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই তাদেরও মুক্তি দেওয়া হবে।”
পরিবারের আনন্দ ও প্রতিক্রিয়া
মুক্তিপ্রাপ্তদের পরিবারের সদস্যরা সংবাদটি শোনার পর আনন্দে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। অনেকেই কারাগারের সামনে উপস্থিত ছিলেন প্রিয়জনদের বরণ করতে। দীর্ঘ ১৫ বছরের অপেক্ষা শেষে পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের আবেগে কারাগার এলাকা হয়ে ওঠে আবেগঘন।
এক মুক্তিপ্রাপ্ত সদস্যের ভাই জানান, “আমরা অনেক বছর ধরে এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে আল্লাহর রহমতে আমার ভাই আজ মুক্তি পেয়েছে। পরিবারের সবাই খুব খুশি।”
স্থানীয়রা জানান, ২০০৯ সালের ঘটনার পর থেকে অনেক পরিবার দুঃসহ সময় পার করেছে। অনেকেই সমাজে কলঙ্কের বোঝা বহন করেছেন। এখন আদালতের সিদ্ধান্তে যারা মুক্তি পাচ্ছেন, তারা নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারবেন বলে আশা করছেন সবাই।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলার অগ্রগতি
পিলখানা ট্র্যাজেডি মামলাগুলোর বিচার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ বিচারপ্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। বিস্ফোরক আইনের মামলার পাশাপাশি মূল হত্যা মামলাতেও শত শত আসামির রায় ঘোষণা করা হয়।
হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন, এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছিল। অনেক আসামি আপিল করেছেন, যার শুনানি এখনো চলছে। বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামিদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে সাজা ভোগ শেষে মুক্ত হয়েছেন অথবা জামিন পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আদালতের এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তদের বিচার শেষে মুক্তি পাওয়া ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক অংশ।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এক মতামতে বলেন, “পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো বড় ঘটনায় বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়েছে, তবে প্রতিটি ধাপে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। আদালত যখন জামিন বা মুক্তির নির্দেশ দেন, তা মানা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”
ভবিষ্যৎ করণীয় ও সম্ভাবনা
মুক্তিপ্রাপ্তদের কেউ কেউ পরিবারে ফিরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পরিকল্পনা করছেন। কারা সূত্র জানায়, মুক্তির পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সমাজে পুনর্বাসনের বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মুক্তি প্রক্রিয়া পিলখানা হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত মামলাগুলোর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এখনো যারা কারাগারে আছেন, তাদের মামলাও ধীরে ধীরে নিষ্পত্তির পথে এগোচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে বিচার ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে দেশের অন্যতম দীর্ঘতম এই বিচার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিডিআরের ৯ সাবেক সদস্যের মুক্তি ২০০৯ সালের ঐতিহাসিক ঘটনার এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে আদালতের নির্দেশে তারা আজ স্বাধীন জীবনে ফিরছেন। এখন নজর থাকবে বাকি চারজনের জামিন যাচাই প্রক্রিয়ার দিকে।
তবে পিলখানা ট্র্যাজেডির ক্ষত এখনো গভীরভাবে দেশের ইতিহাসে অমলিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়বিচারের পূর্ণ বাস্তবায়নই সেই ক্ষত সারাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এম আর এম – ১৭৮৯,Signalbd.com