আঞ্চলিক

মিরপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২১ ঘণ্টা পরও ধোঁয়া

Advertisement

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কেমিক্যাল ও পোশাক কারখানাটি এখনো পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের ২১ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনও ঘন ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে কেমিক্যালের তীব্র ও বিষাক্ত গন্ধ। এ গ্যাসে আশপাশের এলাকার অর্ধশতাধিক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে অনেককেই দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

আগুন নেভাতে টানা প্রচেষ্টা, তবুও জ্বলছে ধোঁয়া

ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট রাতভর অক্লান্ত পরিশ্রম করেও আগুন পুরোপুরি নেভাতে পারেনি। ভেতরে থাকা দাহ্য কেমিক্যাল ও গুদামজাত কাপড়ের কারণে বারবার আগুন জ্বলে উঠছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভেতরে ঢোকার মতো নিরাপদ পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা জোনের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) আবদুল হালিম বলেন,

“আগুনের তীব্রতা কমলেও ভেতরে প্রচুর দাহ্য কেমিক্যাল থাকায় ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভবনের ভেতরে প্রবেশ করা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। আগুন পুরোপুরি নেভাতে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।”

আশপাশের মানুষ অসুস্থ, বন্ধ কারখানা ও অফিস

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই আশপাশের এলাকা ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। কেমিক্যালের তীব্র গন্ধে রাইজিং গ্রুপসহ আশেপাশের কয়েকটি পোশাক কারখানার প্রায় ৫০ জন কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের অনেককে স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

এলাকাজুড়ে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় আশেপাশের অফিস, দোকান ও কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এলাকায় স্বাভাবিক চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল আহমেদ জানান,

“রাত থেকে ধোঁয়ায় পুরো এলাকা ঢেকে আছে। চোখ জ্বালা করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রেখেছি। শিশুরা ও বয়স্করা বেশি ভুগছে।”

আগুনের সূত্রপাত ও উদ্ধার অভিযান

গতকাল মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর শিয়ালবাড়ি রূপনগর এলাকার শাহ আলম কেমিক্যাল গোডাউনে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের পোশাক কারখানায়। আশেপাশের এলাকার মানুষ আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে।

প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও পরবর্তীতে আরও ১৩টি ইউনিট যোগ দেয়। বিকেল নাগাদ আগুন আংশিক নিয়ন্ত্রণে আসে, কিন্তু রাতভর আগুন আবার জ্বলে ওঠে।

হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে, শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা

অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, মরদেহগুলোর অনেকগুলো পুড়ে অচেনা হয়ে গেছে। তাই ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে। নিহতদের স্বজনরা হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষা করছেন, তাদের চোখে কান্না আর শোকের ছাপ।

একজন নিহত কর্মীর স্বজন মেহেদী হাসান বলেন,

“আমার বোন ওই কারখানায় কাজ করত। আগুন লাগার পর থেকে তার খোঁজ পাচ্ছি না। মরদেহগুলোর মধ্যে কেউ তার মতো মনে হচ্ছে, কিন্তু চেনা যাচ্ছে না। এখন ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি।”

ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল: তদন্ত কমিটি গঠন

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, আগুন লাগা ভবনটি ছিল পুরনো এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ভবনের মধ্যে কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, রঙ ও পোশাকজাত দ্রব্য একসঙ্গে মজুত করা ছিল—যা অগ্নিকাণ্ডকে মারাত্মক করে তোলে।

ঢাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। পাঁচ সদস্যের এই কমিটি আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে।

আহতদের অবস্থা ও চিকিৎসা সহায়তা

অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ বা ধোঁয়ায় আক্রান্ত অন্তত ৫৮ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতাল ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে বেশ কয়েকজন চিকিৎসাধীন।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ধোঁয়ায় বিষক্রিয়া, শ্বাসকষ্ট ও চোখে জ্বালাপোড়া নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে এসেছেন।

একজন চিকিৎসক বলেন,

“ধোঁয়ায় থাকা কেমিক্যাল শরীরে প্রবেশ করলে তা মারাত্মক শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে। আক্রান্তদের অনেকের অবস্থাই উদ্বেগজনক।”

সরকারের নির্দেশনা ও সতর্কতা

গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান,

“কেমিক্যাল কারখানাগুলো আবাসিক এলাকার ভেতরে থাকা একেবারেই অনুচিত। দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সরকার ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে কেমিক্যাল গুদাম পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়।

এলাকাজুড়ে আতঙ্ক, সহায়তা চায় ক্ষতিগ্রস্তরা

অগ্নিকাণ্ডে বহু দোকান, কারখানা ও গুদাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে কোটি টাকার মালামাল। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয় সমাজকর্মীরা দুর্গতদের মাঝে খাবার ও পানি বিতরণ শুরু করেছেন। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এলাকায় অবস্থান করছে স্থানীয় প্রশাসনও।

কেমিক্যাল কারখানায় আগুনের পুনরাবৃত্তি

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকায় কেমিক্যাল ও পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। ২০১০ সালের নিমতলীর আগুন, ২০১৯ সালের চকবাজার দুর্ঘটনা এবং ২০২১ সালের নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস অগ্নিকাণ্ডের পরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

আগুন নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইফতেখার রফিক বলেন,

“আমাদের শিল্প এলাকায় এখনও অধিকাংশ কেমিক্যাল গুদাম অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ অবস্থায় আছে। যথাযথ মনিটরিং ও লাইসেন্স ছাড়া এসব কারখানা চললে এমন দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।”

মিরপুরের শিয়ালবাড়ির এই অগ্নিকাণ্ড আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—নগরীর অনিরাপদ কেমিক্যাল কারখানা কত বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রাণহানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের এই শোকাবহ ঘটনা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে সামনে এনেছে।

মানবিক সহায়তা, কঠোর তদারকি ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকানো এখন সময়ের দাবি।

MAH – 13315 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button