
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় দায়িত্ব পালনকালে এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের মাথা ফাটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে এক বিক্রয় প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। সোমবার (১৩ অক্টোবর) সকালে উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের কেরানীহাট হক টাওয়ারের সামনে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে।
আহত ট্রাফিক কনস্টেবল মো. আজাদ উদ্দিন বর্তমানে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত বিক্রয় প্রতিনিধি আবু বক্করকে গ্রেপ্তার করেছে এবং সাতকানিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কেরানীহাট হক টাওয়ার এলাকায় বিক্রয় প্রতিনিধি আবু বক্কর মালামাল নামানোর জন্য তার কাভার্ড ভ্যানটি মহাসড়কের পাশে রেখে যান। তখন ডিউটিতে থাকা ট্রাফিক কনস্টেবল মো. আজাদ উদ্দিন গাড়িটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলেন, যাতে যান চলাচলে বাধা না সৃষ্টি হয়।
এসময় কথাকাটাকাটি শুরু হয় দুজনের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে আবু বক্কর ক্ষিপ্ত হয়ে কনস্টেবলকে গালিগালাজ করেন। পরে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করতে শুরু করলে পুলিশ সদস্য তাকে নিষেধ করেন। এই সময় বিক্রয় প্রতিনিধি একটি স্টিলের টুল দিয়ে কনস্টেবল আজাদ উদ্দিনের মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা ফেটে রক্তাক্ত হন তিনি।
সহকর্মীরা দ্রুত আহত পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
আহত পুলিশের বক্তব্য
আহত কনস্টেবল আজাদ উদ্দিন বলেন, “আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম। বিক্রয় প্রতিনিধি আবু বক্কর রাস্তার ওপর কাভার্ড ভ্যান রেখে দোকানে মাল দিচ্ছিলেন। তাকে বারবার গাড়ি সরাতে বলার পরও তিনি শোনেননি। উল্টো আমাকে গালিগালাজ করেন ও ভিডিও করতে থাকেন। আমি তাকে থামাতে গেলে তিনি টুল দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করেন। পরে আমি পড়ে যাই এবং সহকর্মীরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।”
তিনি আরও বলেন, “আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু এখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে হলো।”
অভিযুক্ত বিক্রয় প্রতিনিধির পরিচয় ও অবস্থান
গ্রেপ্তারকৃত বিক্রয় প্রতিনিধি আবু বক্কর (৩২) সাতকানিয়া উপজেলার নাপিতের চর এলাকার সোনা মিয়ার ছেলে। তিনি স্থানীয় একটি খাদ্যপণ্য কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনার পরপরই তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে পুলিশের অভিযানে কেরানীহাট এলাকা থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার বিষয়ে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, “ঘটনার বিষয়ে কনস্টেবল আজাদ উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। প্রাথমিক তদন্ত শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
পুলিশ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাতকানিয়া সার্কেল) আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, “খবর পাওয়ার পর আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে এবং আহত পুলিশ সদস্যকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করছি।”
তিনি আরও জানান, “সার্ভিস চলাকালে পুলিশের ওপর হামলা একটি গুরুতর অপরাধ। এই ঘটনায় কেউ ছাড় পাবে না।”
সড়কে দায়িত্ব পালনকালীন হামলার পুনরাবৃত্তি
দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা নতুন নয়। সম্প্রতি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। দায়িত্ব পালনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের ওপর হামলার অন্তত ১৫টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতা ও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতা না থাকাই এসব ঘটনার মূল কারণ।
জনমনে প্রতিক্রিয়া ও সামাজিক আলোচনা
এই ঘটনার পর স্থানীয় এলাকাজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পথচারীরা বলছেন, “রাস্তার ওপর মালামাল নামানোর সময় অনেকেই নিয়ম মানেন না। এতে শুধু যানজটই নয়, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে।”
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, “ট্রাফিক পুলিশরা রাস্তা পরিষ্কার রাখতে যে চেষ্টা করেন, তাতে সহযোগিতা করা উচিত। কিন্তু উল্টো তাদের ওপর হামলা সত্যিই দুঃখজনক।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে লিখেছেন, “যে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করে, তাকে এভাবে আঘাত করা সমাজের জন্য হুঁশিয়ারি সংকেত।”
আইনি শাস্তি ও সচেতনতার প্রয়োজন
আইন বিশ্লেষক ও সাবেক সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট শাহ আলম বলেন, “দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা দণ্ডবিধির ৩৫৩ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড পেতে পারেন।”
তিনি বলেন, “এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে জনগণকেও সচেতন হতে হবে যে, সড়ক শৃঙ্খলা রক্ষা সবার দায়িত্ব।”
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ট্রাফিক পুলিশের ওপর হামলার এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত বিরোধ নয়, বরং সমাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সম্মানবোধের অভাবের প্রতিফলন। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনার তদন্ত চলছে, এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায় — নিয়ম মানতে অনীহা আর আইন রক্ষাকারী সংস্থার ওপর হামলার প্রবণতা কমাতে কী ধরনের সামাজিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হবে?
এম আর এম – ১৭৫৭,Signalbd.com