আঞ্চলিক

ঝড়ে ভেসে গেল ঘর, সাত দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে পরিবার

Advertisement

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর এক নিঃস্ব জীবনের গল্প

ঝড়ের ভয়াবহতায় মুহূর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম দলিরাম বানিয়াপাড়ার লালমিয়ার জীবন।
মাত্র কয়েক মিনিটের প্রবল ঝড়ে উড়ে গেছে তাঁর টিনের ছাউনি, ভেঙে গেছে দেয়াল, ছিন্নভিন্ন হয়েছে সংসারের একমাত্র আশ্রয়স্থল—ঘরটি।
আজও সেই ভাঙা ঘরের পাশে খোলা আকাশের নিচে কাটছে তাঁর দিনরাত, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ।

৪০ বছর বয়সী লালমিয়া শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কাজ করতে না পারায় সংসারের দায়িত্ব তাঁর স্ত্রী আনুফা বেগমের কাঁধে। আনুফা স্থানীয় একটি কারখানায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে কাজেও যেতে পারছেন না তিনি। কারণ, ঘর রক্ষার পাশাপাশি দুই সন্তানকে দেখাশোনার দায়িত্ব এখন তাঁর একার।

“সাত দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে আছি”

রবিবার সকালে ঘটনাস্থলে গেলে দেখা যায়, ভাঙা টিনের টুকরোগুলো এখনো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মাটির ওপর ছড়ানো বিছানা, বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়া বইখাতা, ভাঙা চেয়ার-টেবিল—সব মিলিয়ে এক মর্মান্তিক দৃশ্য।

লালমিয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন,

“আমি প্রতিবন্ধী মানুষ, কিছুই করতে পারি না। ঝড়ে ঘরটা উড়ে গেছে, থাকার জায়গা নাই। সাত দিন হলো আমরা খোলা আকাশের নিচে। টাকার অভাবে ঘরটা মেরামত করতে পারছি না। কেউ যদি একটু সাহায্য করে, তাহলে আবার ঘর বানিয়ে থাকতে পারব।”

তাঁর স্ত্রী আনুফা বেগম বলেন,

“রাতে ঘুমাতে পারি না। শিশুরা ঠান্ডায় কাঁপে, কুয়াশায় ভিজে যায় শরীর। কাপড়চোপড়, বইখাতা সব নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের ছেলেটা স্কুলেও যেতে পারছে না এখন। সমাজের কেউ পাশে দাঁড়ালে হয়তো ঘরটা আবার ঠিক করতে পারব।”

গ্রামের মানুষ বলছে—“সবচেয়ে অসহায় পরিবার এটি”

স্থানীয় বাসিন্দা মিস্টার রহমান জানান,

“লালমিয়া আমাদের গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ। তিনি প্রতিবন্ধী, কোনো রকমে জীবন চালান। ঝড়ে তাঁর ঘরটা পুরো উড়ে গেছে। এখন পরিবারটা আকাশের নিচে। প্রশাসন যদি দ্রুত সাহায্য করে, ওরা হয়তো একটু স্বস্তি পাবে।”

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

গাড়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জোনাব আলী বলেন,

“বিষয়টি জানি। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এই পরিবারটিকে সহায়তা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন,

“ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে আমরা ইতিমধ্যে সহায়তা দিয়েছি। লালমিয়ার পরিবারের বিষয়টি জানতে পেরেছি। দ্রুত তাঁদেরও প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হবে।”

ঝড়ের ভয়াবহতা—ক্ষতিগ্রস্ত শত শত পরিবার

গত ৫ অক্টোবর সকালে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বয়ে যায় তীব্র এক ঝড়।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম দলিরাম বানিয়াপাড়া ও আশপাশের গ্রামগুলোয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

স্থানীয়দের ভাষায়, এই ঝড় ছিল যেন “এক মুহূর্তের ঘূর্ণিঝড়।”
মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিট স্থায়ী এই ঝড়ে অসংখ্য ঘরের টিন উড়ে যায়, গাছ উপড়ে পড়ে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য।

কৃষক আব্দুল হালিম জানান,

“আমার তিন বিঘা জমির ধান মাটিতে লুটিয়ে গেছে। ভুট্টা আর কলা গাছ সব ভেঙে গেছে। এমন ঝড় এই সময়ে আমরা আগে দেখিনি।”

জেলার কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী, ঝড়ে কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৩০০টির বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,
এবং ধান, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা ও কলা বাগানের প্রায় ৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

গাছপালা ও দোকানপাটেও ব্যাপক ক্ষতি

স্থানীয় রাস্তার দু’ধারে থাকা শত শত গাছ ভেঙে পড়েছে।
কিছু দোকানপাটের টিনের চাল উড়ে গেছে, ভেতরের মালপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।

দোকান মালিক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,

“ঝড়ের সময় দোকানে ছিলাম না। ফিরে এসে দেখি ছাউনি উড়ে গেছে, ভেতরের সব মাল ভিজে গেছে। কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।”

মানবিক সহায়তার অপেক্ষায় মানুষ

ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখনো অপেক্ষা করছে সরকারি বা বেসরকারি সহায়তার জন্য।
অনেকে স্কুল বা প্রতিবেশীর ঘরে অস্থায়ী আশ্রয়ে আছে, কেউ খোলা মাঠে বা গাছতলায় দিন কাটাচ্ছে।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো কিছু খাদ্য ও কাপড় বিতরণ করেছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

লালমিয়া বলেন,

“আমরা গরিব মানুষ। সরকারের একটু সহযোগিতা পেলেই ঘরটা আবার ঠিক করতে পারব। এখন শীতে কীভাবে বাচ্চাদের নিয়ে থাকব, বুঝতে পারছি না।”

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: ঘন ঘন দুর্যোগ

স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা ও অতিবৃষ্টি বেড়ে গেছে।
আগে যেসব এলাকায় এ ধরনের ঝড় বিরল ছিল, এখন সেখানে নিয়মিত ক্ষতি হচ্ছে।

নীলফামারী সরকারি কলেজের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন,

“জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন গ্রামীণ জীবনেও দৃশ্যমান। আগে মার্চ–এপ্রিল মাসে ঝড় বেশি হতো, এখন দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বর–অক্টোবরেও এমন তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কৃষি ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।”

ঘর হারিয়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

লালমিয়ার দুই সন্তানের মধ্যে বড়জন পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। কিন্তু ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে স্কুলে যেতে পারছে না সে। বই, খাতা, ইউনিফর্ম—সবই বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
ছোটজন এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি, তবে মা-বাবার কষ্ট দেখে প্রতিদিন ভয় পায়।

আনুফা বেগম বলেন,

“আমার ছেলেটা বলছিল, ‘মা, আমরা আর ঘরে ফিরতে পারব না?’ এই কথা শুনে চোখে পানি আসে।”

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি সমাজের সচ্ছল মানুষদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
এমন পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোই মানবতার কাজ।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন,

“আমরা চাই প্রশাসন দ্রুত ত্রাণ বরাদ্দ দিক। পাশাপাশি স্থানীয় সমাজসেবক, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীরাও যদি সহযোগিতা করেন, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”

সারসংক্ষেপ

  • ঘটনা: ৫ অক্টোবরের ভয়াবহ ঝড়ে কিশোরগঞ্জে শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
  • ক্ষতি: ফসল, দোকান, গাছপালা ও বিদ্যুৎ সংযোগে ব্যাপক ক্ষতি
  • সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার: প্রতিবন্ধী লালমিয়ার পরিবার, সাত দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে বসবাস
  • সহায়তার অবস্থা: প্রশাসনের তৎপরতা শুরু হলেও অনেক পরিবার এখনো সাহায্যহীন
  • দাবি: দ্রুত পুনর্বাসন, জরুরি ত্রাণ ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন উদ্যোগ

ঝড়ের পর জীবন যেমন থেমে যায় না, তেমনি মানবতারও শেষ নেই।
লালমিয়ার মতো হাজারো মানুষ এখনো অপেক্ষা করছে একটু সাহায্যের, একটু আশ্রয়ের।
তাঁদের পাশে দাঁড়ানো মানে শুধু একটি ঘর পুনর্নির্মাণ নয়—একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যৎকে বাঁচিয়ে তোলা।

MAH – 13287 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button