আঞ্চলিক

মায়ের লাশ আটকে রেখে সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা, দুই ছেলের হাতাহাতি

Advertisement

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে মায়ের মরদেহ দাফনের আগে দুই ছেলের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে তীব্র বিরোধের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ২০ ঘণ্টা মরদেহ আটকে রেখে চলে হাতাহাতি, শেষ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দাফন সম্পন্ন হয়।

ঘটনাটি যেভাবে ঘটল

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শাহজাদপুর গ্রামে বৃহস্পতিবার সকালে ঘটে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা। জানা গেছে, ১২ শতক জমি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জেরে আমেনা বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মরদেহ দাফনের আগে দীর্ঘ ২০ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। মৃত আমেনা বেগম স্থানীয় মৃত মাওলানা সেলামত উল্ল্যাহর স্ত্রী।

বুধবার সন্ধ্যায় জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় মেয়ের স্বামীর বাড়িতে মারা যান আমেনা বেগম। পরে তাঁর মরদেহ স্বামীর কবরের পাশে দাফনের জন্য নিজ গ্রামে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এর পরপরই সম্পত্তি নিয়ে দুই ছেলের মধ্যে শুরু হয় তর্কাতর্কি, যা এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে রূপ নেয়।

সম্পত্তি নিয়ে দুই ভাইয়ের সংঘর্ষ

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আমেনা বেগম মৃত্যুর আগে ছোট ছেলে সাইফুল্লাহকে কিছু জমি বেশি রেজিস্ট্রি করে দেন। বড় ছেলে নজিব উল্ল্যাহ এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মায়ের মরদেহ দাফন করতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।

গ্রামবাসী জানায়, এক ভাই অন্য ভাইকে অভিযুক্ত করেন মাকে ব্যবহার করে অন্যায্যভাবে সম্পত্তির বড় অংশ দখল করার জন্য। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে দুই ভাই মায়ের মরদেহের সামনেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “আমরা এমন দৃশ্য জীবনে দেখিনি। একজন মা মারা গেছেন, অথচ তাঁর সন্তানরা মায়ের মরদেহের সামনেই মারামারি করছে। এটা হৃদয়বিদারক।”

প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সমঝোতা

খবর পেয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুবাইয়া বিনতে কাশেম ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাঁর উপস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। প্রশাসনের মধ্যস্থতায় অবশেষে সমঝোতায় আসে উভয়পক্ষ। এরপর বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে স্বামীর কবরের পাশে আমেনা বেগমকে দাফন করা হয়।

সহকারী কমিশনার রুবাইয়া বিনতে কাশেম বলেন,

“আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলি। প্রাথমিকভাবে তারা মায়ের মরদেহ দাফনে রাজি হন। দাফনের পর স্থানীয়ভাবে বৈঠক করে সম্পত্তি বিরোধের সমাধান করা হবে বলে তারা আশ্বাস দেন।”

পারিবারিক সম্পত্তি বিরোধের পটভূমি

স্থানীয়দের মতে, আমেনা বেগমের স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই পরিবারের মধ্যে জমি নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। যদিও জীবিত অবস্থায় আমেনা বেগম চেয়েছিলেন সন্তানদের মধ্যে সমঝোতা হোক, কিন্তু তা হয়নি।

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এ ধরনের জমি-সংক্রান্ত বিরোধ নতুন নয়। বিশেষ করে পিতামাতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে অনেক পরিবারেই এমন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পরিসংখ্যান বলছে, গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক বিরোধের প্রায় ৪০ শতাংশই সম্পত্তি ভাগাভাগি সংক্রান্ত।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

গ্রামবাসীরা এই ঘটনাকে পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতীক বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মতে, একজন মা মৃত্যুর পরও সন্তানদের বিবাদ মেটাতে পারেননি—এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।

একজন প্রতিবেশী বলেন, “আজকের এই ঘটনার পর মানুষকে পরিবার ও সম্পর্কের মূল্য বুঝতে হবে। সম্পত্তি জীবনের সবকিছু নয়।”

আরেকজন বলেন, “আমরা প্রশাসনের পদক্ষেপের জন্য কৃতজ্ঞ। তাঁদের হস্তক্ষেপ না থাকলে হয়তো দাফনই সম্ভব হতো না।”

বিশেষজ্ঞের মতামত

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ঘটনা সামাজিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক ঐক্যের অবক্ষয়ের এক বাস্তব চিত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. রেজাউল করিম বলেন, “সম্পত্তি উত্তরাধিকার নিয়ে এমন পারিবারিক বিরোধ এখন প্রায় ঘরোয়া বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা সামাজিক শিক্ষার অভাব ও পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতার ফল।”

তিনি আরও বলেন, “পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছতা ও ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে সমাজে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।”

মায়ের লাশ সামনে রেখে দুই ছেলের এমন বিরোধ কেবল একটি পরিবারের লজ্জাজনক অধ্যায় নয়, বরং সমাজের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও, সম্পত্তি বিরোধের মতো সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইন ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনে স্বচ্ছতা আনতে না পারলে গ্রামীণ সমাজে এমন বিভেদ আরও বাড়বে। প্রশ্ন রয়ে যায়—সম্পত্তির জন্য মানুষ কি নিজের মায়ের মর্যাদাও ভুলে যাচ্ছে?

এম আর এম – ১৭০০,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button