আঞ্চলিক

কক্সবাজারে পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে আসবাবপত্র

Advertisement

পরিবেশ দূষণ রোধে এক অনন্য উদ্যোগ — কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে এমন একটি কারখানা, যেখানে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হচ্ছে টেকসই আসবাবপত্র। এতে যেমন কমছে বর্জ্য দূষণ, তেমনি বাড়ছে কর্মসংস্থান।

পরিবেশ দূষণ ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সংকট মোকাবিলায় কক্সবাজারে শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে টেকসই ও দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্র। এই উদ্যোগ শুধু পরিবেশ সংরক্ষণেই নয়, স্থানীয় নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

পরিবেশবান্ধব রিসাইক্লিং কারখানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে কক্সবাজার পৌরসভা এলাকায় উদ্বোধন হয় দেশের প্রথম প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানার, যেখানে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে ফার্নিচার, খুঁটি, বেঞ্চসহ নানান পণ্য। উদ্বোধন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ।

তিনি বলেন, “এই উদ্যোগ টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এটি যেমন পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও নারীদের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।”

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা নিশাত, ইউএনওপিএস বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজর মেইসন সালাম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জমির উদ্দিন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইবনে মায়াজ প্রামাণিক এবং ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী।

কক্সবাজারের প্লাস্টিক দূষণের বাস্তব চিত্র

বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক এবং পাতলা পলিপ্রোপিলিন উপাদান প্রধান। এসব বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা না হলে তা সাগর ও নদীতে জমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।

এই বিশাল বর্জ্য সমস্যার সমাধানেই “প্লাস্টিক ফ্রি রিভারস অ্যান্ড সিজ ফর সাউথ এশিয়া (PLEASE)” প্রকল্পের আওতায় এই রিসাইক্লিং কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনওপিএসের সহায়তায় এবং ব্র্যাকের বাস্তবায়নে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে।

বর্জ্য থেকে সম্পদে রূপান্তরের যাত্রা

এই কারখানায় সংগ্রহ করা বর্জ্য প্রথমে বাছাই করে আলাদা করা হয়। এরপর পরিশোধন, শুকানো ও প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হয় পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল। এই কাঁচামাল থেকে তৈরি হচ্ছে সোফা, টেবিল, বেঞ্চ, খুঁটি ও বিভিন্ন অফিস আসবাবপত্র।

কারখানার এক নারী কর্মী বলেন, “আগে আমরা রাস্তা থেকে প্লাস্টিক কুড়াতাম, এখন এই কারখানায় কাজ করে নিয়মিত আয় করছি। এটি আমাদের জীবনে স্থিতিশীলতা এনেছে।”

এই উদ্যোগ শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নয়, সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্পের সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত কাঠামো

৫ হাজার ২৮০ বর্গফুট জায়গায় নির্মিত এই কারখানায় প্রতি ঘণ্টায় ২০০ কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম নিশ্চিতে এখানে রয়েছে সোলার পাওয়ার সিস্টেম, তরল বর্জ্য পরিশোধন (ETP) সুবিধা, ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা ও ২৪ ঘণ্টার সিসিটিভি মনিটরিং।

প্রকল্পটির অন্যতম কারিগরি অংশীদার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তাদের নির্বাহী প্রকৌশলী ইবনে মায়াজ প্রামাণিক বলেন, “প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের পাশাপাশি আমরা কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও আধুনিক অবকাঠামো স্থাপন করছি। ভবিষ্যতে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগও নেওয়া হবে।”

নারী কর্মসংস্থান ও স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত

এই কারখানার মাধ্যমে শুধু বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ নয়, স্থানীয় নারীদের ক্ষমতায়নও ঘটছে। বর্তমানে এখানে কর্মরত নারীদের একটি বড় অংশ পূর্বে বর্জ্য সংগ্রাহক ছিলেন। এখন তারা নিয়মিত বেতনভুক্ত কর্মী হিসেবে কাজ করছেন, ফলে জীবনের মান উন্নত হয়েছে।

ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, “আমরা চাই কক্সবাজারকে সম্পূর্ণভাবে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত করতে। এই উদ্যোগ তার একটি বড় পদক্ষেপ। এতে স্থানীয় জনগণের আয় বাড়ছে, পরিবেশ রক্ষাও হচ্ছে।”

বিশেষজ্ঞ মতামত: ‘এটি টেকসই উন্নয়নের মডেল’

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিককে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নতুন পণ্য তৈরির এই মডেলটি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে বড় অবদান রাখবে।

ইউএনওপিএস বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজর মেইসন সালাম বলেন, “সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে এই উদ্যোগটি পরিবেশগত সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকেও এ মডেল অনুসরণ করতে উৎসাহিত করবে।”

তিনি আরও বলেন, “প্লাস্টিক দূষণ কমাতে নাগরিক সচেতনতা, পুনর্ব্যবহার ও সরকারি সহায়তার সমন্বয়ই মূল চাবিকাঠি।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা

কারখানাটির সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই হাতে নেওয়া হয়েছে। আগামী বছর এর উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে কক্সবাজারের বাইরেও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও খুলনায় একই ধরনের প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণ রোধে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

প্লাস্টিক দূষণ থেকে সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশ

কক্সবাজারের এই উদ্যোগ দেখিয়ে দিচ্ছে— সচেতনতা, প্রযুক্তি ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে বর্জ্যও হতে পারে সম্পদ। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এই প্রকল্প এখন দেশের জন্য অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠছে। যদি এই ধারা বজায় থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সমুদ্র ও নদীগুলো আবারও ফিরে পাবে তাদের স্বাভাবিক রূপ।

এম আর এম – ১৬৯৮,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button