আঞ্চলিক

উপদেষ্টার সতর্কবার্তার পরও ১২ কর্মকর্তার খোঁজ নেই, তালাবদ্ধ অফিস

Advertisement

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-বিশ্বরোড এলাকায় সড়ক উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছিলেন ১২ কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকার। কিন্তু পরদিন দেখা গেল তালাবদ্ধ অফিস, অনুপস্থিত সবাই। প্রশ্ন উঠেছে দায়িত্বশীলতার প্রতি।

সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সরাইল-বিশ্বরোড মোড়ে অস্থায়ী কার্যালয়ে ১২ কর্মকর্তার কেউই ছিলেন না। উপদেষ্টার সতর্কবার্তার পরদিনই দেখা যায়, অফিস তালাবদ্ধ, কেউ দায়িত্বে নেই। এই ঘটনায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।

উপদেষ্টার নির্দেশ: ‘ঢাকায় নয়, মাঠেই কাজ করতে হবে’

বুধবার দুপুরে বেহাল মহাসড়ক পরিদর্শনে এসে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান নিজেই যানজটে আটকা পড়েন প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময়। পরে তিনি মোটরসাইকেলে সরাইল-বিশ্বরোডে পৌঁছে প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। পরিদর্শন শেষে তিনি ১২ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন, “এটাই তোমাদের ক্যাম্প অফিস। এখানেই অবস্থান করতে হবে, ঢাকায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দায়িত্বে অবহেলা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তবে সেই নির্দেশনার পরের দিনই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কেউই অফিসে উপস্থিত ছিলেন না। স্থানীয়রা জানান, সকাল থেকে অফিসের তালা ঝুলছিল, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী আসেননি।

চারলেন প্রকল্পে ধীরগতি ও জনদুর্ভোগ

২০২০ সালে আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার সড়ক চারলেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড প্রকল্পটি পরিচালনা করছে। কিন্তু নানা জটিলতা, প্রশাসনিক বিলম্ব এবং বর্ষাকালের ক্ষয়ক্ষতির কারণে পাঁচ বছরেও কাজ শেষ হয়নি।

সম্প্রতি জুলাই অভ্যুত্থানের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ রাখায় মহাসড়কের অবস্থা আরও বেহাল হয়েছে। ছোট-বড় গর্তে ভরা সড়কে প্রায়ই যানজটের সৃষ্টি হয়, ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা।

তদারকির জন্য গঠিত ১২ সদস্যের কমিটি

পরিস্থিতি মোকাবিলায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ আশুগঞ্জ গোলচত্বর এবং সরাইল-বিশ্বরোড মোড়ে খানাখন্দ অস্থায়ীভাবে মেরামতের উদ্যোগ নেয়। কাজের তদারকির জন্য গঠন করা হয় ১২ সদস্যের কমিটি। এতে রয়েছেন ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক, কুমিল্লা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, আশুগঞ্জ-আখাউড়া চারলেন মহাসড়ক প্রকল্পের পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালক, কুমিল্লা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীরা।

উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেন— সবাইকে মাঠে থেকেই কাজ করতে হবে, সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে। তবুও নির্দেশনা কার্যকর হয়নি, যা প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অবহেলার ইঙ্গিত বহন করছে।

অফিসে গিয়ে দেখা গেল তালা, কর্মকর্তাদের অজুহাত

বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সরাইল-বিশ্বরোডের অস্থায়ী কার্যালয় সম্পূর্ণ তালাবদ্ধ। এলাকাবাসী বলেন, “গতকাল উপদেষ্টা আসার পর সবাই ব্যস্ত ছিলেন, আজ কেউই দেখা যায়নি। সকাল থেকে তালা ঝুলছে।”

প্রকল্প ব্যবস্থাপক শামিম আহমেদ বলেন, “আমি লাঞ্চ করতে গিয়েছি, ফিরে আসছি।” আর প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল আওয়াল মোল্লা জানান, “আমরা সাইড অফিসে আছি, সবাই কাজ করছেন।” তবে ১২ কর্মকর্তার মধ্যে কে কোথায় কাজ করছেন— সে বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।

এই অবস্থায় অনেকেই মনে করছেন, কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে উপস্থিতি নিশ্চিত না হলে প্রকল্পের গতি ফেরানো কঠিন হবে।

স্থানীয়দের ক্ষোভ ও দাবি

দীর্ঘদিন ধরে এই মহাসড়কে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। তারা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নাম শুনে যে আশা জেগেছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে হতাশায়। প্রতিদিনের যানজটে সময়, জ্বালানি ও অর্থ— সবই নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ী আবদুল করিম বলেন, “ঢাকা যেতে ৪ ঘণ্টা লাগত, এখন ৮ ঘণ্টা লাগে। প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে।”

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, দ্রুত এই প্রকল্পে তদারকি বাড়ানো না হলে জনরোষ বাড়বে। তাঁরা চান, দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য: ‘প্রকল্পে জবাবদিহির অভাব প্রকট’

অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, “সরকারি প্রকল্পে মাঠপর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং না থাকলে এই ধরনের অবহেলা দেখা যায়। উপদেষ্টা যখন সরাসরি নির্দেশ দেন, তার পরদিনই কর্মকর্তারা অনুপস্থিত থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক।”

তিনি আরও বলেন, “চারলেন প্রকল্পের মতো বড় উদ্যোগে প্রতিটি ধাপের অগ্রগতি দৃশ্যমান করতে হবে। জনগণের করের টাকায় এসব প্রকল্প চলছে, তাই দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য।”

দায়িত্বশীলতা না ফিরলে প্রশ্ন থেকে যাবে

উপদেষ্টার নির্দেশনার পরও ১২ কর্মকর্তার অনুপস্থিতি সরকারি দায়িত্ব পালনের মানসিকতার ওপর প্রশ্ন তুলেছে। এলাকাবাসী এখন অপেক্ষায়, দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা। তবে বাস্তবে মাঠে উপস্থিতি নিশ্চিত না হলে সড়ক উন্নয়নের স্বপ্ন কতটা পূরণ হবে, তা নিয়েই এখন বড় প্রশ্ন।

এম আর এম – ১৬৯৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button