
ঢাকার ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোর একটি মালিবাগ। আর সেখানেই ঘটলো এক নজিরবিহীন স্বর্ণ চুরির ঘটনা। বুধবার (৯ অক্টোবর) গভীর রাতে মালিবাগের ফরচুন শপিং মলের শম্পা জুয়েলার্স নামের একটি দোকান থেকে প্রায় ৫০০ ভরি স্বর্ণ ও নগদ অর্থ লুট হয়ে গেছে।
এর আগে যাত্রাবাড়ীর একটি মার্কেট থেকে স্বর্ণ চুরির ঘটনা ঘটে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই মালিবাগে ঘটে গেল আরও বড় এক চুরি। ফলে রাজধানীর ব্যবসায়ী সমাজ ও ক্রেতাদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কীভাবে ঘটলো চুরির ঘটনা?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাত আনুমানিক ৩টার দিকে চোর চক্রের দুজন সদস্য বোরকা পরে ফরচুন শপিং মলে প্রবেশ করে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দোকানের শাটারের তালা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে দোকানের ভেতরে সাজানো থাকা স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে যায়।
শম্পা জুয়েলার্সের মালিক জানান, তার দোকানে প্রায় ৪০০ ভরির মতো স্বর্ণালঙ্কার ছিল। এছাড়াও গ্রাহকদের জমা রাখা প্রায় ১০০ ভরির বন্ধকি স্বর্ণ এবং প্রায় ৪০ হাজার টাকা নগদ অর্থ ছিল। সবকিছু নিয়ে গেছে দুর্ধর্ষ চোরেরা।
ক্ষতির পরিমাণ কত?
ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, ৫০০ ভরি স্বর্ণের বাজারমূল্য আনুমানিক ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার সমান। এ ছাড়া নগদ অর্থের ক্ষতি তো আছেই। দোকান মালিকের দাবি, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা এটি। শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক বিশ্বাস ও গ্রাহক আস্থাও ভেঙে পড়লো এক নিমিষেই।
ব্যবসায়ী সমাজে আতঙ্ক
স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীতে দুটি বড় চুরির ঘটনা প্রমাণ করছে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর।
মালিবাগ এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বড় শপিং মলগুলোতে সবসময়ই নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত থাকেন। তবুও কীভাবে এ ধরনের দুঃসাহসিক চুরি সম্ভব হলো—এ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।
পুলিশের তদন্ত
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পুলিশের দাবি, সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং চোর চক্রকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এটি পরিকল্পিত একটি চুরি। তারা চক্রটির পেছনে একটি বড় নেটওয়ার্ক থাকার আশঙ্কাও করছে।
পুলিশ আরও জানিয়েছে, একই ধাঁচে যাত্রাবাড়ীর মার্কেটে স্বর্ণ চুরির ঘটনাও ঘটেছিল। তাই দুই ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ীর ঘটনার সঙ্গে মিল
কিছুদিন আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মার্কেটে প্রায় ৩০০ ভরি স্বর্ণ চুরির ঘটনা ঘটে। সেখানেও রাতের অন্ধকারে দোকানের তালা কেটে চোরেরা বিপুল স্বর্ণ নিয়ে যায়। মালিবাগের ঘটনাটি সেই ঘটনারই ধারাবাহিকতা কিনা—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সাধারণ মানুষের উদ্বেগ
স্বর্ণ সাধারণত পরিবারগুলোর সঞ্চয় ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রতীক। বিয়ে থেকে শুরু করে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণের ব্যবহার রয়েছে। তাই এই ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অনেকেই ভাবছেন, নিজের স্বর্ণালঙ্কার নিরাপদে রাখার জায়গাই বা কোথায়? ব্যাংকের লকার ছাড়া আর কোনো ভরসা নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বড় বড় শপিং মলগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রযুক্তি ও জনবল উভয় দিকেই ঘাটতি রয়েছে। তারা বলছেন—
- প্রতিটি দোকানে উন্নত সিসিটিভি স্থাপন করতে হবে।
- নিরাপত্তা প্রহরীদের পেশাদার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- শপিং মলগুলোতে ২৪ ঘণ্টা কার্যকর অ্যালার্ম সিস্টেম থাকতে হবে।
- স্বর্ণ ব্যবসায়ীদেরও সচেতন হতে হবে এবং ব্যাংক লকারে অতিরিক্ত স্বর্ণ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাজুসের দাবি
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি বলছে, এ ধরনের ঘটনা যদি বারবার ঘটতে থাকে তবে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, পাশাপাশি সরকারও কর রাজস্ব হারাবে। বাজুস দ্রুত এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ
ঢাকার মতো জনবহুল শহরে প্রতিদিন নানা অপরাধ ঘটে চলেছে। এর মধ্যে স্বর্ণ চুরি, চুরি–ডাকাতি এবং ছিনতাই এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বড় আকারের স্বর্ণ চুরি বেড়ে যাওয়ায় পুলিশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
ঘটনার সামাজিক প্রভাব
এ ধরনের চুরি কেবল ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতিই করছে না, সমাজে ভয় ও অনিরাপত্তার পরিবেশও তৈরি করছে। অনেক ব্যবসায়ী ভাবছেন দোকান বন্ধ করে দেবেন, আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত নিরাপত্তা খরচ বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
যাত্রাবাড়ীর ঘটনার রেশ না কাটতেই মালিবাগে ৫০০ ভরি স্বর্ণ চুরি নিঃসন্দেহে একটি বড় দুঃসাহসিক ঘটনা। এই ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের গ্রেপ্তার না হলে ব্যবসায়ী সমাজে আতঙ্ক আরও বাড়বে। একইসাথে দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
MAH – 13240 I Signalbd.com