আঞ্চলিক

উদয়ন এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত: সিলেট-ঢাকা রেল যোগাযোগ বন্ধ

Advertisement

আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫) সকালে সিলেট জেলার মোগলাবাজার এলাকায় ভয়াবহ এক রেল দুর্ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিলেটগামী পথে লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানির খবর না পাওয়া গেলেও ট্রেনটির একাধিক বগি লাইন থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ফলে মুহূর্তেই সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন। দুর্ঘটনার কারণে সকাল থেকেই সিলেটমুখী কিংবা সিলেট থেকে ছেড়ে আসা সব ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

যাত্রীদের আতঙ্ক ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

লাইনচ্যুত হওয়ার মুহূর্তে ট্রেনের ভেতরে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যাত্রীরা ভয়ে চিৎকার করতে থাকেন, অনেকে জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয় এবং ট্রেনের কয়েকটি বগি লাইন থেকে ছিটকে গিয়ে কাত হয়ে যায়।

যাত্রী রহিম উদ্দিন বলেন:
“ভোরে ট্রেন ছাড়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মোগলাবাজারের কাছাকাছি আসতেই প্রচণ্ড শব্দ হয়, তারপর দেখি ট্রেন কেঁপে উঠল। আমরা জীবন নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।”

স্থানীয় বাসিন্দারাও দুর্ঘটনার শব্দ শুনে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং যাত্রীদের নিরাপদে বের হতে সহায়তা করেন।

দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কারণ হিসেবে রেললাইন নষ্ট হওয়া, অতিরিক্ত চাপ বা সিগন্যাল সমস্যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মোগলাবাজার স্টেশনের কাছাকাছি অংশে রেললাইনের যান্ত্রিক ত্রুটি বা মাটির নরম হয়ে যাওয়ার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

রেলওয়ের প্রকৌশলীরা ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন এবং তদন্ত শুরু করেছেন।

সিলেটের রেল যোগাযোগে বিপর্যয়

এই দুর্ঘটনার কারণে সিলেট থেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।

যেসব আন্তঃনগর ট্রেনের সিলেটগামী বা সিলেট থেকে ছাড়ার কথা ছিল—যেমন কালনী এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস—সবগুলোই অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ফলে হাজার হাজার যাত্রী স্টেশনগুলোতে আটকা পড়েছেন।

উদ্ধার তৎপরতা ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্থানীয় প্রশাসনের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। যদিও বড় ধরনের প্রাণহানি হয়নি, তবে বেশ কয়েকজন যাত্রী সামান্য আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা রাশেদুল করিম বলেন:
“আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেছি। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে আমরা লাইনচ্যুত বগিগুলো সরানোর চেষ্টা করছি।”

যাত্রীসাধারণের ভোগান্তি

সিলেট অঞ্চলের জন্য রেল যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিমান ও সড়কপথ থাকলেও রেলের ওপরই সাধারণ মানুষের নির্ভরশীলতা বেশি। এই দুর্ঘটনার ফলে হাজারো যাত্রী তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে পারছেন না।

বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসা, ব্যবসা কিংবা পড়াশোনার কাজে যাতায়াতকারী যাত্রীদের জন্য এই দুর্ঘটনা ব্যাপক সমস্যা তৈরি করেছে।

পূর্বে ঘটে যাওয়া অনুরূপ দুর্ঘটনা

বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসে সিলেট অঞ্চলে এ ধরনের দুর্ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০১৯ সালের জুন মাসে ময়মনসিংহগামী একটি ট্রেন কুলাউড়ায় লাইনচ্যুত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।

সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি মাটি, টিলা কেটে তৈরি রেললাইন এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে প্রায়ই রেললাইনে ত্রুটি দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।

রেলওয়ের প্রতিক্রিয়া

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। পাশাপাশি দ্রুত মেরামত কাজ শুরু করা হবে যাতে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা যায়।

রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেছেন:
“আমরা ঘটনার কারণ খুঁজে বের করব এবং ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রীদের নিরাপত্তাই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার।”

বিশ্লেষণ: কেন বারবার রেল দুর্ঘটনা ঘটছে?

বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণগুলো হলো—

  • রেললাইনের দুর্বল অবস্থা
  • নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব
  • অতিরিক্ত যাত্রী চাপ
  • পুরোনো ইঞ্জিন ও বগি
  • আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকা

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রেল খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।

ভবিষ্যৎ করণীয়

১. নিয়মিত রেললাইন পরিদর্শন ও মেরামত
২. নতুন ও আধুনিক বগি ও ইঞ্জিন সংযোজন
৩. দুর্ঘটনা এড়াতে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু
৪. রেলওয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি
৫. স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা

উদয়ন এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত হওয়ার এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল—বাংলাদেশ রেল খাতকে আধুনিকায়ন ছাড়া যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সৌভাগ্যক্রমে এবার বড় ধরনের প্রাণহানি হয়নি, তবে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরো সিলেট অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

MAH – 13198 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button