অর্থনীতি

বিমা খাতে সংকট: আইডিআরএর উদ্বেগ ও সমাধান

Advertisement

দেশের বিমা খাতের অবস্থা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) জানিয়েছে, দেশের মোট ৮২টি বিমাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে জীবনবিমা ও সাধারণ বিমা খাতে সমস্যা বেশি গভীর। ৩২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে, আর ১৫টি জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান মধ্যম ঝুঁকির। এই খবর দেশের বিমাখাতের উন্নয়ন ও গ্রাহকদের আস্থার জন্য বড় ধাক্কা।

বিমা খাতের সংকট ও আইডিআরএর উদ্বেগ

ঢাকার দিলকুশায় আইডিআরএ কার্যালয়ে বুধবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, দেশের বিমা খাত বর্তমানে সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দেশের প্রায় ১৩ লাখ গ্রাহকের ৪ হাজার ৪১৪ কোটি টাকার বিমা দাবি এখনও পরিশোধ হয়নি। জীবনবিমা কোম্পানিগুলোতে পলিসির দাবির ৪৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোতে ৪৬ শতাংশ দাবি এখনও মেলেনি।

আসলাম আলম বলেন, বিমা দাবির টাকা পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় সাধারণ মানুষের বিমা খাতের ওপর আস্থা কমছে। “বিনা জবাবদিহি, স্বচ্ছতার অভাবে মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায় না,” তিনি বলেন। এই সংকট দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন তিনি।

বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকির বিশ্লেষণ

আইডিআরএ’র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জীবনবিমা খাতে মোট ৩৬টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান উচ্চ ঝুঁকির, ১৫টি মধ্যম ঝুঁকির, আর ৬টি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে মধ্যম ঝুঁকির প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা তুলনামূলক সহজেই সমাধানযোগ্য। সাধারণ বিমা খাতে মোট ৪৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠান উচ্চ ঝুঁকিতে আছে।

ঝুঁকির এই তথ্যগুলি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা, সম্পদ ও অন্যান্য সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

বিমা খাতের অবনতি: গ্রাহক কমে গেছে লক্ষাধিক

আইডিআরএর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে দেশের বিমা খাতে গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৫৪ লাখ কমেছে। বর্তমানে মোট চালু থাকা পলিসির সংখ্যা ৭১ লাখ। দেশের মোট জিডিপির অনুপাতে বিমা খাতের অবদান ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ২০১০ সালে বিমা খাতের অবদান ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের ০.৯৪ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে নামিয়েছে মাত্র ০.৪১ শতাংশে। ২০২৪ সালে এই হার আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।

আইডিআরএ’র জনবল সংকট এবং অভিযোগের পাহাড়

সংস্থাটির চেয়ারম্যান জানান, আইডিআরএতে অনুমোদিত জনবল ১৬০ জন হলেও, বর্তমানে মাত্র ১০৭ জন কর্মরত আছেন। জনবল কম থাকার কারণে ২০২৪ সালে প্রায় ২৪,৮৫২টি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও তদারকি করতে পারেনি সংস্থাটি।

এই জনবল সংকট মেটাতে আইডিআরএ ৫৩৫ জনের কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে ৪১ জন তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে থাকবে। আইডিআরএ’র কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিমা খাতে সংস্কার: আইন, ডিজিটাল ও প্রাতিষ্ঠানিক

আইডিআরএ ঘোষণা করেছে, বিমা খাতে আস্থা বৃদ্ধির জন্য তিনটি প্রধান খাতে সংস্কার আনা হচ্ছে — প্রাতিষ্ঠানিক, আইনগত এবং ডিজিটাল।

  • নতুন আইন প্রণয়ন ও সংশোধনী: বর্তমানে বিমা আইনের ১৬০টি ধারা রয়েছে। আইডিআরএ ২৩টি নতুন ধারার প্রস্তাব করেছে এবং ৫৬টি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, যা ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আদলে তৈরি হচ্ছে। এই আইন প্রণয়ন হলে বিমাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করা সহজ হবে।
  • ডিজিটালাইজেশন: বিমা খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে, যাতে পলিসি লেনদেন ও দাবির প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ হয়।
  • প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক করতে কাজ চলছে।

নিবন্ধন নবায়ন ফি বৃদ্ধি

আইডিআরএ প্রস্তাব করেছে, বিমা কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন নবায়ন ফি প্রতি হাজার পলিসিতে ১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করার। ২০১২ সালে এই ফি ছিল ৩.৫ টাকা, ২০১৮ সালে তা কমিয়ে ১ টাকায় নামানো হয়েছিল। এফি বৃদ্ধির মাধ্যমে সংস্থাটির আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা।

মোটরযান বিমা: বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা

আইডিআরএ চেয়ারম্যান জানান, ২০১৮ সালে গাড়ির বিমা ঐচ্ছিক করা হয়েছিল। এর ফলে অনেকেই মোটরযান বিমা করাচ্ছেন না। তবে মোটরযান বিমা অত্যাবশ্যক। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করে মোটরযানের বিমার সঙ্গে জরিমানা সংযোজনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

বিমা খাতের গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিমা খাত দেশের আর্থিক সুরক্ষা ও বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমানে ঝুঁকি ও আস্থার অভাব দেশের এই খাতের উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইডিআরএর তৎপরতা, জনবল বৃদ্ধি, আইনি সংস্কার ও ডিজিটাল উদ্ভাবনের মাধ্যমে আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই বিমা খাত থেকে সুশৃঙ্খলতা ফিরে আসবে এবং গ্রাহক আস্থা পুনঃস্থাপন হবে।

বিমাখাতের উন্নয়ন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সেজন্য সকল স্টেকহোল্ডারকে একযোগে কাজ করতে হবে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button