
মাদারীপুরে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন যাত্রী। শনিবার (৪ অক্টোবর) গভীর রাতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাদারীপুর সদর উপজেলার সমাদ্দার এলাকায় এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তি ট্রাকের চালক বলে জানিয়েছে পুলিশ। আহতদের উদ্ধার করে দ্রুত মাদারীপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটলো
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা ইউনিক পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাদারীপুরের সমাদ্দার এলাকায় পৌঁছায়। একই সময় বিপরীত দিক থেকে একটি মালবাহী ট্রাক দ্রুতগতিতে আসছিল। মুহূর্তের মধ্যেই বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ট্রাকের সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। অপরদিকে বাসের যাত্রীদের মধ্যে অন্তত ১০ জন গুরুতর আহত হন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য
মাদারীপুরের মোস্তফাপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান—
“দুর্ঘটনার পরপরই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা মিলে উদ্ধার তৎপরতা চালায়। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মহাসড়ক প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে অতিরিক্ত গতির কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে বিস্তারিত তদন্ত শেষে সঠিক কারণ জানা যাবে।
আহতদের অবস্থা
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। এ ছাড়া কারও হাত-পা ভেঙে গেছে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা শেষে বেশ কয়েকজনকে ভর্তি করা হয়েছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী বলেন,
“সবকিছু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হয়ে গেল। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড শব্দ, তারপর বাসের ভেতরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। অনেকে সিট থেকে ছিটকে পড়ে যায়।”
সড়ক দুর্ঘটনার সামগ্রিক চিত্র
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালেই দেশে প্রায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়েছেন কয়েকগুণ বেশি মানুষ। এর মধ্যে মহাসড়কেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- অতিরিক্ত গতি
- ক্লান্ত অবস্থায় চালানো
- ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা
- সড়কের নাজুক অবস্থা
- ট্রাফিক আইন অমান্য
স্থানীয়দের ক্ষোভ
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এই মহাসড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। রাতের বেলায় ট্রাক ও বাসচালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
একজন স্থানীয় দোকানদার বলেন,
“আমরা প্রায়ই এখানে দুর্ঘটনা দেখি। সড়কে পর্যাপ্ত লাইটিং নেই, আবার চালকরা রাতের বেলায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চালান। পুলিশের উচিত নিয়মিত নজরদারি বাড়ানো।”
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
- মহাসড়কে গতিসীমা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন।
- চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা।
- দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড, লাইট ও সিসি ক্যামেরা বসানো।
- ট্রাফিক পুলিশের টহল বাড়ানো।
- চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
সরকারি উদ্যোগ
সরকার সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মহাসড়কে নজরদারি ক্যামেরা স্থাপন, হাইওয়ে পুলিশ মোতায়েন, দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোতে ব্রেকার বসানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। তবুও দুর্ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া এবং চালকদের অসচেতনতা এই সমস্যার মূল কারণ।
মানবিক দিক
প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু একটি সংখ্যা নয়—এটি একটি পরিবারকে শোকাহত করে তোলে। নিহত ট্রাকচালকের পরিবার এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। তার উপর নির্ভরশীল পরিবার কেমন কষ্টে দিন কাটাবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মাদারীপুরের এই দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করল যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলো এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই প্রয়োজন সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও সচেতন হওয়া। নিরাপদ সড়ক কেবল আইন প্রয়োগে নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চিত করা সম্ভব।
MAH – 13161 I Signalbd.com