
টানা বৃষ্টিতে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় ফেনী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা। ভেঙে গেছে অন্তত ১৪টি স্থানে বাঁধ, প্লাবিত হয়েছে ৩৫টিরও বেশি গ্রাম। প্রশাসন বলছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় চলছে তৎপরতা।
বৃষ্টিপাত ও নদীর পানি বৃদ্ধিতে ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
গত পাঁচ দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে ফেনী জেলার মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমার ৫০–৯৫ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত জেলায় সর্বোচ্চ ৪০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে, যা চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ।
ফলে ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞাঁ ও সোনাগাজী উপজেলার নিম্নাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে গেছে অন্তত ১৪টি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৩৫টি গ্রামের হাজারো মানুষ।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ব্যাপক ভাঙন, পানি ঢুকছে লোকালয়ে
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। পরশুরামের জঙ্গলঘোনা, শালধর, অলকা ও তুলাতলী এলাকায়, এবং ফুলগাজীর দৌলতপুর ও উত্তর শ্রীপুরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। পরশুরামের সাহেববাজারের দক্ষিণে সিলোনিয়া নদীর পানি বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।
ফুলগাজীর বাসিন্দা মাসুদুর রহমান বলেন,
“ভাঙন স্থান দিয়ে প্রতিনিয়ত পানি প্রবেশ করছে। প্রতি ঘণ্টায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।”
শহরের অভ্যন্তরে জলাবদ্ধতা, জনজীবন বিপর্যস্ত
ফেনী শহরের প্রধান সড়কগুলো হাঁটু পানিতে ডুবে গেছে। অফিসমুখী মানুষ, শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগে পড়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা স্থগিত করেছে। শহরের নিচু এলাকায় থাকা বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।
পরীক্ষার্থী সামিয়া ইসলাম বলেন,
“বৃষ্টির মধ্যে ভিজেই পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে। বাসা থেকে বের হওয়াই ছিল চ্যালেঞ্জ।”
ফেনী পৌর প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন বলেন,
“পূর্ববর্তী সময়ে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।”
আবহাওয়ার পূর্বাভাস: বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। ফলে নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ইনচার্জ মো. মুজিবুর রহমান বলেন,
“টানা বৃষ্টির প্রভাবে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যদি উজানে বৃষ্টিপাত কমে, তাহলে পানি কমার সম্ভাবনা আছে।”
প্রশাসনের তৎপরতা ও আশ্রয় ব্যবস্থা
জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার ও সহায়তার জন্য কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান জানান,
“আমরা ভাঙনকবলিত এলাকাগুলিতে নজর রাখছি। প্রয়োজনে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হবে।”
পরিণতি ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
নদীর পানি বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, যদি বৃষ্টি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে। তাছাড়া যেসব বাঁধ এখনো অসমাপ্ত, সেগুলোর কারণে আশপাশের গ্রামগুলো আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
ফেনীর এই আকস্মিক বন্যা আবারও প্রকৃতি ও অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আগামী কয়েকদিন পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা নির্ভর করছে বৃষ্টিপাত ও প্রশাসনের ব্যবস্থাপনার ওপর।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—বারবার এমন দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার পরও, আমরা কি স্থায়ী কোনো সমাধান খুঁজে পাব?
এম আর এম – ০২৪৭, Signalbd.com