
খুলনায় নবজাতক চুরির মামলায় মানব পাচার আইনে গ্রেপ্তার হওয়া শাহাজাদী ও তার মা নার্গিস বেগম জামিন পেয়েছেন। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. শরীফ হোসেন হায়দার তাদের বিশেষ বিবেচনায় জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিনের কপি হাতে পাওয়ার পরপরই শাহাজাদীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। আর নার্গিস বেগমকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঘটনা
মামলার সূত্রে জানা যায়, শাহাজাদী (৩৬) গত ১১ সেপ্টেম্বর খুলনার একটি হাসপাতালে পঞ্চম কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু ছেলে সন্তানের আশা করায় স্বামী সিরাজুল ইসলাম নবজাতক জন্মের পর স্ত্রী ও সন্তানকে ফেলে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর পর থেকে শাহাজাদী ও তার শিশুটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
১৫ সেপ্টেম্বর একই হাসপাতালের আরেক প্রসূতির নবজাতক সন্তান চুরি হওয়ার ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ নবজাতককে উদ্ধার করে এবং শাহাজাদীর মা নার্গিস বেগমকে গ্রেপ্তার করে। তিনি দাবি করেন, মেয়ের সংসার রক্ষার জন্যই তিনি এ কাজ করেছিলেন।
আদালতে হাজিরা ও কারাগারে পাঠানো
২১ সেপ্টেম্বর মা-মেয়ে দুজনকেই আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহাজাদীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সে সময় তার ১১ দিনের নবজাতকও মায়ের সঙ্গে প্রিজন ভ্যানে চড়ে কারাগারে যায়। এই দৃশ্য সারা দেশে তীব্র আলোড়ন তৈরি করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
জামিন আবেদন ও আদালতের সিদ্ধান্ত
আসামিপক্ষের আইনজীবী শেখ রফিকুজ্জামান বলেন, মঙ্গলবার সকালে আদালতে জামিন আবেদন করা হলে বিচারক বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। তিনি আরও জানান, নবজাতককে নিয়ে মায়ের কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি আদালত মানবিকভাবে বিবেচনা করেছেন।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাটি সামনে আসার পর থেকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একটি নবজাতককে মায়ের সঙ্গে কারাগারে পাঠানো কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলে। অনেকে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে নবজাতকদের এমন অবস্থায় ফেলাটা মানবাধিকারের পরিপন্থী।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত আইনি কাঠামোর মধ্যে থাকলেও মানবিক দিকটি সব সময় বিবেচনায় রাখা উচিত। এক আইনজীবী বলেন, “বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মায়ের অপরাধ থাকলেও শিশুকে কখনো শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত নয়।”
অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ঘটনা পরিবার ভাঙন ও সামাজিক চাপের ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। স্বামী সন্তান জন্মের পর স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যাওয়া এবং তার পরের ঘটনায় এক ধরনের পারিবারিক সংকট স্পষ্ট হয়েছে।
সরকারের ভূমিকা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। নবজাতক চুরির পেছনে অন্য কোনো চক্র জড়িত আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও মানবিক দিক বিবেচনায় এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নতুন করে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি উঠেছে।
মা শাহাজাদী ও তার মা নার্গিস বেগমের জামিন মঞ্জুরের মাধ্যমে আপাতত একটি অস্থায়ী সমাধান হলেও পুরো ঘটনাটি সমাজের নানা সংকট ও আইনের মানবিক প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এখন দেখার বিষয়, মামলার চূড়ান্ত রায় কী দাঁড়ায় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্র কতটা কার্যকর ভূমিকা নেয়।
এম আর এম – ১৪৮০,Signalbd.com