বাংলাদেশ

আন্দোলনকারীদের গুলি করতে ওয়্যারলেস বার্তায় নির্দেশ দিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান

Advertisement

গত বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীতে চলমান আন্দোলন দমনে তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ওয়্যারলেস বার্তায় আন্দোলনকারীদের গুলি করার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মঙ্গলবার এই বার্তা প্রমাণ হিসেবে জমা দিয়েছে প্রসিকিউশন। মামলার সাক্ষ্য ও অডিও রেকর্ডে উঠে এসেছে, এই নির্দেশের পরপরই ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় ৬ জন নিহত হন।

হাবিবুর রহমানের ওয়্যারলেস নির্দেশ

ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত প্রসিকিউশনের তথ্যমতে, গত বছরের ১৮ জুলাই বিকেলে ডিএমপির কন্ট্রোল রুম থেকে হাবিবুর রহমান ওয়্যারলেসে বলেন, “আপনারা সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিলিং পজিশনে গিয়ে কোমরের নিচে গুলি চালান।”
প্রসিকিউটরের দাবি, এই নির্দেশ ছিল সুস্পষ্টভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি।

২০২৪ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের একাধিক ঘটনা ঘটে।
১৮ জুলাইয়ের ঘটনাটি ঘটে তখন, যখন রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। চানখাঁরপুল, শাহবাগ, মলচত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

গুলি চালানোর পরিণতি

প্রসিকিউশনের তথ্যমতে, হাবিবুর রহমানের নির্দেশে চানখাঁরপুল এলাকায় প্রায় ৪০-৪৫ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। তৎকালীন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে গুলি চালানো হয়।
গুলিতে ঘটনাস্থলেই ৬ জন নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী শাহারিয়ার খান আনাস, যিনি আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে পরিবারের উদ্দেশে একটি আবেগঘন চিঠি লিখে যান। তার পরিবার ময়নাতদন্ত ছাড়াই ‘শহীদি মর্যাদায়’ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়।

আদালতে উপস্থাপিত প্রমাণ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, হাবিবুর রহমানের ওয়্যারলেস বার্তা, ঘটনাস্থলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ, এবং কনস্টেবলদের গুলির নির্দেশনা—সব কিছু অডিও রেকর্ড আকারে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া, ডিএমপির এক কনস্টেবল ওই ঘটনার দিন কন্ট্রোল রুমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে উল্লেখ করেছিলেন যে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর নির্দেশ এসেছে।

আসামিদের অবস্থা

চানখাঁরপুলে ৬ জনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় মোট আটজন সাবেক পুলিশ সদস্য আসামি। এদের মধ্যে চারজন—হাবিবুর রহমান, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, শাহ্ আলম ও ইমরুল—পলাতক রয়েছেন। বাকিদের মধ্যে আরশাদ হোসেন, সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম বর্তমানে কারাগারে আছেন এবং ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে।

পরিবার ও স্বজনদের প্রতিক্রিয়া

নিহতদের পরিবারগুলো এ ঘটনায় গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। শাহারিয়ার খান আনাসের বাবা আদালতে জবানবন্দি দিয়ে বলেন, “আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে তার দেশের জন্য আন্দোলনে নেমেছিল। এই হত্যার দায় সাবেক কমিশনার হাবিবুর ও তার সহযোগীদের।”
তিনি আরও জানান, ছেলে মারা যাওয়ার পরও কোনো তদন্ত বা ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা পাননি।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংস্থা এবং শিক্ষার্থী সংগঠন তীব্র নিন্দা জানায়। তারা মনে করে, এই নির্দেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি রাষ্ট্রীয় দমননীতির উদাহরণ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের পরিপন্থী।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের নির্দেশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহারের শামিল। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ওয়্যারলেস বার্তাটি প্রমাণ হিসেবে আদালতে টিকে গেলে এটি হবে একটি নজিরবিহীন রায়, যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের সীমা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।

শেষ কথা 

হাবিবুর রহমানের ওয়্যারলেস নির্দেশ এবং পরবর্তী ঘটনাবলী বর্তমানে আদালতের বিচারাধীন। প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং অডিও রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে আদালত চূড়ান্ত রায় দেবেন। তবে এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের একটি বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এম আর এম – ০৮১৯, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button