আঞ্চলিক

কুমিল্লার হোমনা: ‘মাজারের অপরাধডা কী, তাঁরায় মাজারে হামলা করলো ক্যারে’

Advertisement

কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর গ্রামে চারটি মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তিমূলক পোস্টকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে স্থানীয় ভক্ত ও গ্রামবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী বর্তমানে গ্রামে টহল জোরদার করেছে।

হামলার বিস্তারিত ঘটনা

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আসাদপুর গ্রামের মহসিন (৩৫) নামের এক যুবক ফেসবুকে কটূক্তিমূলক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে গত বুধবার গ্রেপ্তার হন। পরদিন সকালে আদালতের মাধ্যমে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই কয়েক শতাধিক লোক একত্র হয়ে চারটি মাজারে হামলা চালায়।

আক্রমণের শিকার মাজারগুলো হলো—কফিল উদ্দিন শাহের মাজার, আবদু শাহের মাজার, কালু শাহের মাজার এবং হাওয়ালি শাহের মাজার। হামলাকারীরা মাজার ভাঙচুরের পাশাপাশি কয়েকটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। লুটপাটও চালানো হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

সরেজমিনে পরিস্থিতি

ঘটনার পর শুক্রবার দুপুরে আসাদপুর গ্রামে গেলে দেখা যায়, মাজারগুলোর সামনে এখনো পোড়া ঘরের ধোঁয়া উঠছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা শাখার সদস্যরাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

কফিল উদ্দিন শাহের মাজারের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাঁর ভক্ত মনির হোসেন বলেন, “১৫ বছর ধইরা আমি এই মাজারের মুরিদ। এইখানে খারাপ কিছু হয় না। আমরা জানতে চাই, মাজারের অপরাধডা কী? তাঁরায় মাজারে হামলা করলো ক্যারে?”

মাজারের খাদেম ও ভক্তদের প্রতিক্রিয়া

মাজারের বর্তমান খাদেম রফিকুল ইসলাম জানান, প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ জন মানুষ হামলায় অংশ নেয়। কয়েকজন স্থানীয় ধর্মীয় নেতাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হামলাকারীরা শুধু ভাঙচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং দানবাক্স ভেঙে অর্থ লুট করেছে। এমনকি ভক্তদের মোবাইল ফোন ভেঙে দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ ভিডিও ধারণ করতে না পারে।

আবদু শাহের মাজার পরিষ্কার করছিলেন ভক্ত খায়ের মিয়া। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আবদু শাহ ছিলেন পরহেজগার মানুষ। তাঁর মাজারে হামলা আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।”

গ্রামবাসীর আতঙ্ক ও ক্ষয়ক্ষতি

মাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাড়িঘরেও হামলার প্রভাব পড়েছে। আলেক শাহ নামের এক পরিবারের ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাঁর মেয়ে কানন বেগম বলেন, “আমরা মহসিনের কাজকে কোনোভাবেই সমর্থন করিনি। উল্টো আমরাই তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু কেন আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো?”

হাওয়ালি শাহের মাজারের খাদেম হাওয়া বেগম জানান, হামলাকারীরা তাঁর বাড়িতেও আগুন দিয়েছে। যদিও সেখানে কোনো সমাধিস্থল ছিল না, কেবল মাজারসদৃশ একটি স্থাপনা ছিল।

পুলিশের ভূমিকা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

পুলিশ জানায়, ঘটনার দিন সকালে বিক্ষোভকারীরা আসাদপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জমায়েত হয়। শুরুতে ৫০০ জনের মতো লোক থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তা কয়েক হাজারে পৌঁছে যায়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

হোমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম মহসিনকে গ্রেপ্তারের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মব তৈরি হয়ে মাজারে হামলা চালাবে, এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল।”

তিনি আরও জানান, হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতামত

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জহিরুল ইসলাম মনে করেন, হামলাকারীদের বড় অংশ বহিরাগত ছিল। তিনি বলেন, “গ্রামের মানুষ এভাবে হঠাৎ সংগঠিত হয়নি। বাইরে থেকে লোক এনে মাজারে হামলা চালানো হয়েছে।”

অভিজ্ঞ সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, কটূক্তিমূলক পোস্টের দায় নির্দিষ্ট একজনের হলেও, সেটিকে অজুহাত করে নিরীহ পরিবারের বাড়িঘর ও মাজারে হামলা করা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। এ ধরনের সহিংসতা সামাজিক সম্প্রীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

আসাদপুরের মাজারগুলোতে হামলা শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেনি, বরং গ্রামবাসীর সামাজিক জীবনে ভয়াবহ ক্ষত তৈরি করেছে। ভক্তদের প্রশ্ন এখন একটাই—“মাজারের অপরাধটা কী?”

এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কীভাবে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনে এবং কীভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করা হয়।

এম আর এম – ১৪২৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button