
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের পূর্বশত্রুতার জেরে দুই ভাই—আনোয়ার ও হামজা—একটি নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে বড় মসজিদপাড়া এলাকায় ঘটে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহতরা উথলী গ্রামের মাঝেরপাড়ার মৃত খোদা বক্স মণ্ডলের দুই ছেলে—আনোয়ার, বয়স ৫৫, এবং হামজা, বয়স ৪৫। জানা যায়, কয়েক বছর আগে গরু কেনাবেচা নিয়ে স্থানীয় কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে তাদের মধ্যে বিরোধের সূচনা হয়। বিবাদের উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং শনিবার সকালে সেই উত্তেজনা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়।
সকালে দুই ভাই মাঠে কৃষিকাজ করতে বের হন। সেই সময় পূর্বশত্রুতার জেরে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় প্রতিপক্ষ। খবর অনুযায়ী, হামলাকারীরা লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে দুই ভাইকে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করে। স্থানীয়রা আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তবে সেখানে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানান, আনোয়ার ও হামজা সবসময় শান্তপ্রিয় ছিলেন। তারা গরু পালন ও কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে তাদের বিরোধ প্রকট আকার নেয়। স্থানীয়রা মনে করেন, এই বিরোধ আগে থেকেই পরিকল্পিত হত্যার দিকে ধাবিত হয়েছিল।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ওয়াহিদ মাহমুদ রবিন বলেন, “দুজনকেই একযোগে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আনোয়ার হাসপাতালে আসার আগেই মারা যান। আর হামজা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।” তিনি আরও জানান, লাঠির আঘাত এবং ধারালো দেশীয় অস্ত্রের চিহ্ন ছিল উভয়ের শরীরে।
পুলিশের পদক্ষেপ
জীবননগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন হোসেন বিশ্বাস সংবাদমাধ্যমকে জানান, “ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করা হয়েছে। আমরা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলছি এবং ঘটনার সত্যতা উদঘাটন করতে প্রতিটি প্রমাণ সংগ্রহ করছি।”
তিনি আরও জানান, “এই হত্যাকাণ্ড পূর্বশত্রুতার জের ধরে সংঘটিত হয়েছে। তবে আমরা সকল দিক খতিয়ে দেখছি, যাতে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায়।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
নিহতদের প্রতিবেশীরা এই হত্যাকাণ্ডকে শোকস্মৃতিমূলক এবং ভয়ঙ্কর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা জানান, “এ ধরনের হিংসা আগে কখনো ঘটেনি। আমরা চাই আইনের মাধ্যমে দ্রুত ন্যায়বিচার হোক।” অনেকে নিরাপত্তার জন্য গ্রামে আরো পুলিশ মোতায়েনের দাবি করেছেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, “প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত দোষী সাব্যস্ত করতে হবে।”
গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট
চুয়াডাঙ্গা জেলায় পূর্বশত্রুতার জেরে সংঘটিত হিংসার ঘটনা নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন বিরোধ এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদের কারণে অনেক হত্যা, হামলা ও চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক সচেতনতা এবং পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।
গ্রামের বহু বাসিন্দা মনে করেন, “আমরা চাই ছোটখাটো বিরোধ যেন বড় হিংসার রূপ না নেয়। এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের বিশেষ পদক্ষেপ জরুরি।”
আইনের দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড একটি গুরুতর অপরাধ। ৩০২ ধারায় হত্যাকারীদের ফাঁসির দণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
প্রভাবিত পরিবার ও সম্প্রদায়
নিহত দুই ভাইয়ের পরিবার শোকাহত। স্থানীয়রা বলছেন, “দুই ভাই আমাদের গ্রামের মমতাময় মানুষ ছিলেন। তাদের হারানো আমাদের জন্য এক অগণিত ক্ষতি।” তাদের স্ত্রী, সন্তান এবং আত্মীয়রা এখন মানসিক চাপে ভুগছেন।
সম্প্রদায়ের নেতা জাকির হোসেন বলেন, “এ ধরনের হত্যাকাণ্ড শুধু পরিবারকেই নয়, পুরো গ্রামকেই আতঙ্কিত করে। আমরা চাই গ্রামে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার হোক এবং হত্যাকারীরা দ্রুত গ্রেফতার হোক।”
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে সংঘটিত এই নির্মম হত্যাকাণ্ড পুরো জেলার জন্য একটি সতর্কবার্তা। সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। আশা করা যায়, হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে গ্রামের মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসবে।
চুয়াডাঙ্গার এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, ছোটখাটো বিরোধও কখনো কখনো বড় বিপদের সূত্রপাত হতে পারে। তাই সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ আরও কার্যকর হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
MAH – 12905 I Signalbd.com