এক বছরেও বিচার হয়নি আবু সাঈদের: ভাইয়ের দুঃখ-অভিযোগ

জুলাই আন্দোলনের স্মরণীয় শহীদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। কিন্তু মৃত্যুর এক বছর পেরিয়েও তার হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রমের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
এই বাস্তবতায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী। বুধবার (১৬ জুলাই) বাবুনপুরে নিজ বাড়িতে যমুনা টেলিভিশনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের সব স্তরের অনেক মানুষ আমাদের বাসায় এসেছেন, কবর জিয়ারত করেছেন এবং বিচার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু আজও ভাই হত্যার কোনো অগ্রগতি বা বিচারালয়ের কোনো আলামত আমরা পাইনি।”
বিচারহীনতার ধ্বংসাত্মক হতাশা
রমজান আলী আরো বলেন, “আমার ভাই যখন জীবন দিলো, তখন সে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিল। তার এই আত্মত্যাগের কারণ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ভাইয়ের হত্যার বিচার নিয়ে এক বছর পার হলেও কোনো ন্যায়বিচার হয়নি। আমরা জানি সে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে, কিন্তু বিচার এখনও শুরু হয়নি—এটাই সবচেয়ে কষ্টের।”
তিনি এই দুঃখের কথা জানাতে কোথাও পাচ্ছেন না। “আমাদের আর বলার ভাষা নেই,” বলেই তিনি চোখে অশ্রু নিয়ে অভিযোগ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রতিশ্রুতিতে ব্যর্থতা
রমজান জানান, “প্রধান উপদেষ্টা, সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এমনকি প্রধান বিচারপতিও আমাদের বাসায় এসেছেন। সবাই আমাদের ভাইয়ের জন্য বিচার দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বছর কেটে গেলেও বিচার শুরু হয়নি। আমরা খুবই দুঃখিত এবং শোকাহত।”
আবু সাঈদের আত্মত্যাগ ও মুক্তচিন্তার সূচনা
রমজান আলী আবু সাঈদের আত্মত্যাগের কারণে দেশে মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমার ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে আজ মানুষ বলতে পারছে, নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। অনেকেই এসেছে বাবা-মায়ের কাছে কেঁদে বলেছে, ‘আপনার ছেলের জন্য আমরা মুক্ত।’ কেউ কেউ বলেছে, ‘আমার মৃত্যুদণ্ড ছিল, কিন্তু বেঁচে গেছি।’”
তবে তিনি স্পষ্ট করেন যে, “বাংলাদেশে এখনো বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। বিচার ব্যবস্থা আগের মতোই। অগ্রগতি শূন্য।”
রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিচার ও সংস্কারের বাধা
রমজান আরও অভিযোগ করেন, “দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব ও কুৎসা ছোঁড়াছুঁড়ির কারণে প্রধান উপদেষ্টা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত একজন ব্যক্তি, যিনি সুষ্ঠু বিচার ও নির্বাচন সংস্কার করতে পারবেন। তবে রাজনৈতিক অশান্তির কারণে তাকে কাজের সুযোগ দেয়া হয়নি।”
সংবিধান সংশোধন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি
রমজান আলী বলেন, “দেশে পরিবর্তন এসেছে, সুতরাং সংবিধানও পরিবর্তন প্রয়োজন। এই পরিবর্তন ও সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা যাবে। আবু সাঈদের প্রদত্ত আলোর পথ যেন বৈষম্যমুক্ত, স্বাধীন ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করে।”
শহীদ আবু সাঈদ: জীবনী ও আন্দোলন
গত বছরের ১৬ জুলাই, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের এই শিক্ষার্থী তার সাহসী প্রতিবাদের মাধ্যমে দেশের মুক্তচিন্তার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তার মৃত্যুপরবর্তীতে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়।
শহীদ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি
শহীদ দিবস উপলক্ষে রংপুরের বীরগঞ্জের বাবুনপুরে আবু সাঈদের কবর জিয়ারত এবং বিশেষ শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নেবেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. রফিকুল আকবর, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এস এম এ ফায়েজ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শওকত আলী এবং সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তারা।
এছাড়া বিএনপি, জামায়াত, এনজিপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও শহীদ আবু সাঈদের স্মরণে শোকসভা ও কবর জিয়ারত করেছে।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মরণ সভা ও অনুষ্টান
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকাল ১০টায় কালো ব্যাজ পরিধান করে শিক্ষার্থীরা শোক প্রকাশ করবেন। এরপর শোকযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আবু সাঈদের পিতা মকবুল হোসেন, বিশেষ অতিথি হিসেবে রংপুরের শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটে ‘শহীদ আবু সাঈদ তোরণ’ এবং পার্ক মোড়ে ‘আবু সাঈদ মিউজিয়াম’ উদ্বোধনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হবে।
আবু সাঈদের মৃত্যু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এক জ্বলন্ত প্রতীক। তার হত্যার বিচার ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবি আজও তরতরিয়ে উঠছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে দেশের ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা।