ট্রাকের ধাক্কায় মা-মেয়ে নিহত: বগুড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় শোকের ছায়া

ঘটনাস্থলে করুণ মৃত্যু
বগুড়ার কাহালু উপজেলায় ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রী মা-মেয়ে নিহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় অটোরিকশাচালক গুরুতর আহত হন। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার দরগাহাট বাজার এলাকায় বগুড়া-নওগাঁ আঞ্চলিক মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন—আদমদীঘি উপজেলার ইন্দইল গ্রামের বাসিন্দা রতনের স্ত্রী আইনুন নাহার আশা (৩৭) ও তাঁর কন্যা আরাত (৬)।
কাহালু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিতাই চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, আইনুন নাহার মেয়েকে নিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় আদমদীঘির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। পথে দরগাহাট এলাকায় ভান্ডার ফ্যাক্টরির সামনে অজ্ঞাতনামা একটি ট্রাক অটোরিকশাটিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই আইনুন নাহারের মৃত্যু হয়।
দ্রুত খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা গুরুতর আহত আরাত ও চালককে উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক ছোট্ট আরাতকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত চালকের নাম এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
ওসি নিতাই চন্দ্র সরকার আরও জানান, ট্রাকটিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহত মা-মেয়ের মরদেহ পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।
স্থানীয়দের চোখে ঘটনাস্থলের বর্ণনা
দুর্ঘটনার পর স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনাটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে অটোরিকশাটি প্রায় দু’ভাগ হয়ে যায়। আশপাশের লোকজন দৌড়ে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন,
“এই সড়ক দিয়ে বড় বড় ট্রাক অত্যন্ত বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রশাসনের তেমন নজর নেই। এই মা-মেয়ের মৃত্যু পুরো এলাকায় শোকের ছায়া ফেলেছে।”
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা দীর্ঘদিন ধরেই একটি ভয়াবহ সমস্যা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন হলো—অটোরিকশা, মোটরসাইকেল এবং মালবাহী ট্রাক।
- ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী:
- প্রায় ৫,২১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬,৭০০ জন নিহত এবং ৮,০০০ এর বেশি আহত হয়েছেন।
- এর মধ্যে প্রায় ৩০% দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া ট্রাক ও বাসচালনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে অতিরিক্ত যানবাহন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, প্রশিক্ষণহীন চালক এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই দুর্ঘটনার মূল কারণ।
আইন প্রয়োগ ও বাস্তব চ্যালেঞ্জ
সরকার একাধিকবার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। “সেফ রোড” কর্মসূচি, ট্রাফিক আইন সংশোধন এবং হাইওয়ে পুলিশ মোতায়েন—এসব উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবেই দুর্ঘটনা কমছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন:
- হাইওয়েতে মালবাহী ট্রাকের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
- প্রতিটি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স সঠিকভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।
- মহাসড়কে সিসিটিভি মনিটরিং বাড়াতে হবে।
- দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
নিহত পরিবারে শোকের মাতম
আইনুন নাহার আশা ছিলেন স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষিকার ছোট বোন। পরিবারে তাঁর হঠাৎ মৃত্যুতে শোকের মাতম নেমে এসেছে। স্বামী রতন একমাত্র কন্যা ও স্ত্রীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। গ্রামের মানুষেরা ভিড় করেছেন শোকাহত পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে।
গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক মো. সালাউদ্দিন বলেন,
“আমাদের এলাকায় এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু নিহত পরিবারগুলো কোনো বিচার বা ক্ষতিপূরণ পায় না। আজ আইনুন আর ছোট্ট মেয়ের মৃত্যু আমাদের সবাইকে নাড়া দিয়েছে।”
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কী হতে পারে?
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন:
- কঠোর আইন প্রয়োগ: দুর্ঘটনাজনিত হত্যাকাণ্ডের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া।
- ট্রাফিক সচেতনতা বৃদ্ধি: চালক ও যাত্রী উভয়ের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক প্রচারণা।
- সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন: মহাসড়কে আলাদা লেন তৈরি, রাস্তার পাশে আলোকসজ্জা বৃদ্ধি।
- প্রযুক্তির ব্যবহার: স্পিড ক্যামেরা, GPS মনিটরিং এবং সিসিটিভি স্থাপন।
- দ্রুত চিকিৎসা সুবিধা: দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ও রেসকিউ টিম নিশ্চিত করা।
বগুড়ার কাহালুতে মা-মেয়ের করুণ মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকে নয়, পুরো সমাজকে শোকাহত করেছে। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল যে বাংলাদেশের সড়কপথ এখনো অরক্ষিত। প্রতিদিন হাজারো মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় চলাচল করছে।
সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক সমাজ যদি একসঙ্গে এগিয়ে না আসে, তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা থামানো যাবে না। নিহত মা-মেয়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং পরিবারটির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
MAH – 12840 Signalbd.com