ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একসঙ্গে জন্ম হওয়া যমজ ছয় নবজাতকের মধ্যে পাঁচটি শিশু মারা গেছে। বর্তমানে কেবল একটি মেয়ে শিশু বেঁচে আছে, তবে তার অবস্থাও সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। রবিবার সকালে এই বিরল প্রসবের ঘটনায় পরিবার ও হাসপাতালজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি করুণ রূপ নিয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বাসিন্দা মোকসেদা আক্তার প্রিয়া (২৩) রবিবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে স্বাভাবিকভাবে ছয় সন্তানের জন্ম দেন। শিশুদের জন্মের সময় গর্ভধারণের ২৭ সপ্তাহ চলছিল। নবজাতকগুলোর ওজন ছিল ৬১৫ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রামের মধ্যে, যা জীবনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
জন্মের পরপরই তিনটি নবজাতককে ঢাকা মেডিকেলের এনআইসিইউতে এবং বাকি তিনটি শিশুকে বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে পাঁচটি শিশুর মৃত্যু হয়। সোমবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে তিনটি মৃত্যু ঘটে এবং রবিবার রাতে মারা যায় আরও দুটি নবজাতক।
পরিবারের বর্ণনা
প্রিয়ার ননদ ফারজানা আক্তার জানান, শিশুদের মৃত্যুর পর গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে পরিবারে। তিনি বলেন, “আমরা সবাই ভেবেছিলাম হয়তো আধুনিক চিকিৎসার সহায়তায় অন্তত কিছু শিশু বেঁচে থাকবে। কিন্তু একে একে তাদের হারাতে হলো। এখন শুধু একটি শিশু বেঁচে আছে, কিন্তু সেও ভালো নেই।”
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইতোমধ্যেই পাঁচ নবজাতকের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর সন্তানদের মা প্রিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা
ঢাকা মেডিকেলের নবজাতক বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. নিলুফার ইয়াসমিন জানান, ২৭ সপ্তাহ বয়সী গর্ভধারণে জন্ম নেওয়া শিশুরা অপরিপক্ব থাকায় তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম থাকে। সাধারণত ৩৭ থেকে ৪০ সপ্তাহে পূর্ণ মেয়াদের শিশু জন্ম নেয়। এ কারণে ছয় নবজাতকের জন্ম একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, “বাচ্চাগুলোর জন্মের সময় ওজন ছিল খুব কম। এত অল্প ওজনে টিকে থাকা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল, কিন্তু শারীরিক জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।”
বিরল ঘটনা: ছয় সন্তানের জন্ম
বাংলাদেশে একসঙ্গে ছয় সন্তানের জন্ম অত্যন্ত বিরল ঘটনা। সাধারণত চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ ধরনের জন্মকে ‘মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি’ বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের গর্ভধারণে মা ও শিশু উভয়ের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
প্রিয়া প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিলেও শেষ পর্যায়ে ব্যথা শুরু হলে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। এখানে এসে স্বাভাবিকভাবে ছয় নবজাতকের জন্ম দেন তিনি।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি জানাজানি হতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অনেকেই নবজাতকদের জন্য দোয়া করার আহ্বান জানান। তবে শিশুদের মৃত্যুর খবরে সর্বত্র নেমে আসে শোকের ছায়া।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা পেলে এমন জটিলতা কিছুটা হলেও কমানো যেত। তবে এত অল্প সময়ে ছয়টি নবজাতক জন্ম নেওয়া স্বাভাবিকভাবেই চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
পরিসংখ্যান ও তুলনা
- ছয় নবজাতকের জন্ম: ১৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা
- জন্মের সময় গর্ভকাল: ২৭ সপ্তাহ
- ওজন: ৬১৫ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম
- মৃত্যু: রবিবার থেকে সোমবারের মধ্যে মোট ৫ নবজাতক
- জীবিত: ১ মেয়ে শিশু, অবস্থাও সংকটাপন্ন
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
গাইনোকোলজিস্ট ও নবজাতক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের জটিল গর্ভধারণে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুঁকি শনাক্ত করে উন্নত সেন্টারে চিকিৎসা নিলে নবজাতক টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা কিছুটা বাড়ে।
তারা আরও বলেন, দেশে এনআইসিইউ সেবার মান বৃদ্ধি, গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
ঢামেকে জন্ম নেওয়া ছয় নবজাতকের মধ্যে পাঁচটির মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্যই করুণ সংবাদ। এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্রও তুলে ধরেছে। এখনো জীবিত থাকা নবজাতকটির জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এ ধরনের জটিল গর্ভধারণে আগে থেকে বিশেষায়িত প্রস্তুতি নিলে কি ফলাফল ভিন্ন হতে পারত?
এম আর এম – ১৩৪৪,Signalbd.com



