ঋণের দায়ে আত্মহত্যা’ করেছিলেন মিনারুল, ঋণ নিয়ে ১২০০ জনের জন্য চল্লিশা

রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার পর অনুষ্ঠিত হলো এক অভাবনীয় আয়োজন। কৃষক মিনারুল ইসলাম, যিনি ঋণের দায়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছিলেন, তার চল্লিশা উপলক্ষে আয়োজন করা হয় দোয়া ও খাবারের। তবে এই আয়োজন করতে গিয়ে তার বাবা রুস্তম আলীকে আবারও ঋণ নিতে হয়েছে, যা পরিশোধ করতে এখন জমি বিক্রি করতে হবে।
ঘটনাটির বিস্তারিত
গত ১৫ আগস্ট সকালে নিজ বাড়ি থেকে মিনারুল ইসলাম (৩৫), তার স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩০), ছেলে মাহিম (১৪) ও মেয়ে মিথিলা (৩)-এর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পাশে পাওয়া যায় একটি চিরকুট, যেখানে মিনারুল লেখেন— “আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।”
পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুতে পুরো গ্রাম শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। ঠিক এক মাস পর, গত শনিবার তাদের জন্য চল্লিশার আয়োজন করা হয় মিনারুলের বাড়িতে। এ সময় আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামের অসংখ্য মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
চল্লিশার আয়োজন
বাড়ির সামনে ও পেছনে দুটি বড় প্যান্ডেল করা হয়। অতিথিদের জন্য ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ডাল ও মুড়িঘণ্ট। দুপুরে দোয়ার পর প্রায় ১২০০ জন মানুষকে খাওয়ানো হয়।
রুস্তম আলী নিজেই অতিথিদের সেবা করতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলেন, “বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসছি, এমন চল্লিশা করতে হয়। মন থেকে আয়োজন করেছি। মাংস করতে পারিনি, সামর্থ্য ছিল না। তাই ডাল আর মাছ দিয়ে মুড়িঘণ্ট করেছি।”
ঋণের বোঝা থেকে আবারও ঋণ
চল্লিশার আয়োজন করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান রুস্তম আলী। এই টাকা জোগাড় করতে তাকে ধার করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমার তো জমা টাকা নেই। সবই ধারদেনা। এখন এক কাঠা জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হবে। না করলে চলবে না।”
এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, যেখানে ঋণের দায়ে চারজনের মৃত্যু হলো, সেখানে আবার ঋণ নিয়ে আয়োজন করাটা কতটা যৌক্তিক।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
গ্রামের মানুষ কেউ কেউ আয়োজনটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। অনেকেই মনে করেন, সমাজের রেওয়াজের চাপে এমন আয়োজন করতে হয়েছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “চারজন মানুষ একসঙ্গে মারা যাওয়ার পর বাড়িটা যেন ভারী হয়ে ছিল। চল্লিশা করার পর পরিবেশটা কিছুটা হালকা হয়েছে।”
অন্যদিকে অনেকে মনে করছেন, এ ধরনের অযৌক্তিক ব্যয় আসলে ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়, যা পরিবারকে আবারও সংকটে ফেলছে।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক রেওয়াজ
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী বলেন, “ইসলামের দৃষ্টিতে চল্লিশার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আমাদের এলাকায় এটা অনেকদিন ধরে প্রচলিত রেওয়াজ।”
ধর্মীয় দিক থেকে বিতর্ক থাকলেও সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে গিয়েই অধিকাংশ পরিবার এমন আয়োজন করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে আর্থিক সংকটে থাকা পরিবারগুলো আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।
দারিদ্র্য, ঋণ ও সামাজিক চাপ
এই ঘটনা শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং গ্রামীণ সমাজের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। দারিদ্র্য ও ঋণের কারণে বহু পরিবার প্রতিনিয়ত সংকটে পড়ে। এর সঙ্গে সামাজিক চাপ যুক্ত হলে তা মর্মান্তিক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজে সচেতনতা বাড়ানো দরকার যাতে দুঃসময়ে মানুষ সহমর্মিতা দেখায়, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি না করে। একই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দরিদ্র কৃষকদের জন্য কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
পরিশেষে
ঋণের দায়ে জীবন দিলেন মিনারুল ও তার পরিবার, অথচ তাদের স্মরণে আবারও ঋণ করতে হলো বাবাকে। এটি একদিকে বেদনাদায়ক, অন্যদিকে আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির কঠিন বাস্তবতা।
প্রশ্ন রয়ে গেল— ঋণের ফাঁদ ও সামাজিক রীতিনীতি মিলিয়ে আর কত পরিবারকে এমন শোকাবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে?
এম আর এম – ১৩২৮,Signalbd.com