ডাকসুতে ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতির ভূমিধ্বস পরাজয় হয়েছে: আসিফ নজরুল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে রাজনৈতিক মহল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের বিপুল জয় প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, “ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতির ভূমিধ্বস পরাজয় হয়েছে।”
আসিফ নজরুলের প্রতিক্রিয়া
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে আসিফ নজরুল ডাকসু নির্বাচনের বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি তার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। একই সঙ্গে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের ফলাফল মেনে নেওয়ার জন্য প্রশংসা করেন তিনি।
তার ভাষায়, “শিবিরের বিশাল বিজয় নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। আমি শুধু একটা কথা বলব— এই নির্বাচনে ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতির ভয়াবহ পরাজয় হয়েছে।”
ট্যাগ রাজনীতির প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ছাত্রদের ‘শিবির ট্যাগ’ দেওয়া হতো। এর ফলে বহু শিক্ষার্থী অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাসে হঠাৎ করে পুলিশি অভিযান, শিবির সন্দেহে ছাত্রদের মারধর ও হয়রানির ঘটনা ছিল নিয়মিত।
আসিফ নজরুল তার পোস্টে এ প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, “হাসিনার আমলে অসংখ্য শিবির কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীকে ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। শিবির সন্দেহে অনেককে পেটানোর পর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হতো। আমি সবসময় এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছি, যদিও এতে আমাকে নানা হুমকি ও আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে।”
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও লেখনী
আসিফ নজরুল উল্লেখ করেন, তিনি ট্যাগ রাজনীতির প্রভাব বুঝতে পেরে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘আমি আবু বকর নামে’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। বইটি সেই বছরের একুশে বইমেলায় বিপুল সাড়া ফেলে এবং মাত্র এক মেলায় ১১ বার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। তার মতে, “তখন এর কারণ পুরোপুরি বুঝিনি, এখন বুঝতে পারছি কেন বইটি এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল।”
তিনি ডাকসুর বিজয়ী নেতাদের উদ্দেশে বলেন, “আমার অনুরোধ, গণঅভ্যুত্থানে যারা ভূমিকা রেখেছেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করুন। ছাত্রসমাজের ঐক্যই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার প্রসঙ্গ
শুধু নির্বাচনী ফলাফল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যদিনের সমস্যা নিয়েও মন্তব্য করেন আসিফ নজরুল। তিনি সলিমুল্লাহ হলে জুমার নামাজ পড়তে যাওয়ার সময়ের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
তার মতে, “বারান্দায় চৌকি, ভাঙা টেবিল-চেয়ার আর মশারি দেখে মনে হতো বস্তি। ক্যান্টিনগুলো ছিল লঙ্গরখানার মতো, আর আবাসিক কক্ষগুলোর ভেতরে উঁকি দিতে চাইত না মন।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, “ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান হবে।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসিফ নজরুলের মন্তব্য বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রথা— ট্যাগ রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ।
একজন শিক্ষা বিশ্লেষক বলেন, “ডাকসুর নির্বাচনে এই ফলাফল এবং নজরুলের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করছে, শিক্ষার্থীরা আর ট্যাগের রাজনীতি মানতে চাইছে না।”
অন্যদিকে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষ্য, “বাংলাদেশে ট্যাগ রাজনীতির মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে ভয় দেখানো হয়েছিল। ডাকসুর নির্বাচন সেই ভয় ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ।”
ভবিষ্যৎ প্রভাব
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল এবং আসিফ নজরুলের মন্তব্য কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। ছাত্ররাজনীতির ধারা অনেক সময়েই জাতীয় রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে।
অনেকে মনে করছেন, ট্যাগ রাজনীতির পতন ভবিষ্যতে ছাত্ররাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক করে তুলবে। তবে সেটি বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, সেটি নির্ভর করবে বিজয়ী নেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর।
ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জয়ে যেমন নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত মিলেছে, তেমনি আসিফ নজরুলের প্রতিক্রিয়া ছাত্রসমাজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে সামনে এনেছে। তার মতে, ট্যাগ রাজনীতির পরাজয় কেবল একটি নির্বাচনী ফল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক ইতিবাচক সংকেত। এখন দেখার বিষয়, নতুন নেতৃত্ব কিভাবে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়।
এম আর এম – ১২৭৬,Signalbd.com