ভাঙ্গায় সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে টানা অবরোধ, উত্তেজনায় দুই মহাসড়ক

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো অবরোধ চলছে। সকাল থেকে হাজারো মানুষ ঢাকা-বরিশাল ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে নেমে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ব্যস্ত দুই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে, ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজারো যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিক।
কিভাবে শুরু হলো এই আন্দোলন?
ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে ফরিদপুর-৪ আসনের অংশ ছিল। এই আসনে ভাঙ্গা ছাড়াও সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যদিকে ফরিদপুর-২ আসন ছিল নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা নিয়ে গঠিত।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন গত ৪ সেপ্টেম্বর নতুন গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, দেশের মোট ৪৬টি সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে ফরিদপুর-৪ আসনের দুটি ইউনিয়ন (আলগী ও হামিরদী) কেটে নিয়ে ফরিদপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত প্রকাশের পরপরই ভাঙ্গা জুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা বলছেন, তাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক সুবিধাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সড়ক অবরোধে ভোগান্তি চরমে
আজ বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টা থেকে হামিরদী ইউনিয়নের পুকুরিয়া, হামিরদী, মাধবপুর ও নওয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে এবং মুনসুরাবাদ ও সুয়াদী এলাকায় অবরোধ শুরু হয়। যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাসসহ সব ধরনের পরিবহন থমকে দাঁড়ায়।
রোদ থেকে বাঁচতে আন্দোলনকারীরা মহাসড়কের ওপর সামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নেন। এতে শুধু ভাঙ্গা নয়, ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা রুটের যাত্রীরা কয়েক ঘণ্টা ধরে আটকে পড়েন। জরুরি রোগী পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্সও আটকে থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
এলাকাবাসীর দাবি ও ক্ষোভ
অবরোধে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষরা এক কণ্ঠে বলছেন—
“ভাঙ্গাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা কোনোভাবেই মানা হবে না। যতদিন প্রয়োজন, মহাসড়ক অবরোধ থাকবে। প্রয়োজনে জীবন দেব, কিন্তু ভাঙ্গার বিভক্তি মানব না।”
তাদের অভিযোগ, স্থানীয় জনমত না নিয়েই নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ গণতন্ত্রে জনগণের মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশাসনের অসহায়ত্ব
ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকিবুজ্জামান বলেন,
“আমরা অনেকটা অসহায়। এলাকাবাসীর দাবি পূরণ না হলে তারা রাস্তা ছাড়বে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এত মানুষের ভিড়ে জোর করে কাউকে সরানো সম্ভব নয়।”
অন্যদিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লা জানান,
“এটি স্থানীয় কোনো বিষয় নয়, জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। তাই প্রশাসনের করার তেমন কিছুই নেই। এলাকাবাসীর দেওয়া স্মারকলিপি ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে।”
আইনি লড়াইও চলছে
প্রথমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পর স্থানীয়রা লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। ৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব নির্বাচন কমিশন সচিবকে বিবাদী করে গেজেট বাতিলের নোটিশ পাঠান। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব না পাওয়ায় ৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করা হয়।
রিট আবেদন করেছেন বিএনপি নেতা মো. শহিদুল ইসলাম বাবুলসহ স্থানীয় পাঁচজন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, জনগণের মতামত ছাড়াই সীমানা পরিবর্তন করা গণতন্ত্রবিরোধী।
নির্বাচন কমিশনের অবস্থান
এদিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে জানানো হয়েছে, গেজেট প্রকাশের পর আর কোনো পরিবর্তনের সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের বলেন,
“আইন অনুযায়ী সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। বিক্ষোভ-আন্দোলন করেও কোনো লাভ হবে না।”
এই বক্তব্য স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফরিদপুর আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। আসন সীমানা পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থাকতে পারে। কোনো দল বা প্রার্থীর পক্ষে সুবিধা তৈরি করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও জল্পনা চলছে।
অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরির জন্য কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এতে ভাঙ্গার মানুষ নিজেদের অবহেলিত ভাবছেন।
ভাঙ্গার মানুষ কী হারাচ্ছে?
- প্রশাসনিক বিভক্তি: আগে ভাঙ্গার সব ইউনিয়ন একসঙ্গে থাকায় উন্নয়ন পরিকল্পনা সহজ ছিল। এখন দুই ভাগে বিভক্ত হলে সমন্বয় জটিল হবে।
- রাজনৈতিক প্রভাব কমবে: ভাঙ্গার ভোটার সংখ্যা কমে গেলে সংসদে প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হতে পারে।
- সাংস্কৃতিক ঐক্য ভাঙবে: আলগী ও হামিরদীর মানুষের দীর্ঘদিনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সদরপুর ও চরভদ্রাসনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। এখন সেই বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে।
সামনে কী হতে পারে?
১. হাইকোর্টে রিটের রায় যদি ভাঙ্গার পক্ষে যায়, তবে সীমানা পুনর্বিন্যাস বাতিল হতে পারে।
২. কিন্তু যদি আদালত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে রায় দেয়, তবে আন্দোলন আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
৩. পরিবহন অবরোধ দীর্ঘ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভাঙ্গার আন্দোলন শুধু একটি উপজেলার দাবি নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন। জনগণের মতামত ছাড়া বড় ধরনের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরূপ প্রভাব যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তারই উদাহরণ হচ্ছে এই অবরোধ।
এখন সবার দৃষ্টি হাইকোর্ট ও নির্বাচন কমিশনের দিকে। ভাঙ্গার মানুষ কি তাদের ঐতিহাসিক ঐক্য ফিরে পাবে, নাকি নতুন বাস্তবতায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হবে—সময়ই সেই উত্তর দেবে।
MAH – 12728, Signalbd.com