পটুয়াখালীর বাউফলে আলোচিত কিশোরী উর্মী ইসলাম হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন উর্মীর বাবা নজরুল বয়াতি, মা আমেনা বেগম ও ভগ্নিপতি কামাল হোসেন। আদালতে তারা তিনজনই জবানবন্দি দিয়ে অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রথমে নিহতের বাবা নিজেই বাদী হয়ে মামলা করলেও শেষ পর্যন্ত সেই তিনিই হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ধরা পড়লেন।
ঘটনার বিস্তারিত
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ আগস্ট রাতে পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে উর্মী ইসলামকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ গুমের উদ্দেশ্যে কুম্ভখালী খালে ফেলে দেন অভিযুক্তরা। দুই দিন পর, শনিবার সকালে স্থানীয়দের খবরের ভিত্তিতে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।
পুলিশ তদন্তে প্রথম থেকেই পরিবারের সদস্যদের সন্দেহের তালিকায় রাখে। মঙ্গলবার রাতে নজরুল বয়াতি, আমেনা বেগম ও কামাল হোসেনকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা অপরাধ স্বীকার করেন। পরে বুধবার আদালতে হাজির করা হলে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বিস্তারিত জবানবন্দি দেন।
আদালতে স্বীকারোক্তি
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনজনই জানান, পারিবারিক কলহ ও মেয়ের প্রেমঘটিত সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অশান্তি চলছিল। একপর্যায়ে উত্তেজনার মধ্যে উর্মীকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে মরদেহ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।
বাউফল সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আরিফ মুহাম্মদ শাকুর সাংবাদিকদের জানান, “আমরা প্রথম থেকেই পরিবারের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত শুরু করি। ঘটনাস্থল ও প্রাথমিক তথ্য যাচাই করে তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হয়। আদালতে তারা তিনজনই অপরাধ স্বীকার করেছেন।”
মামলার পটভূমি
ঘটনার পরদিন উর্মীর বাবা নজরুল বয়াতি নিজেই বাদী হয়ে বাউফল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, তার মেয়ে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হয়েছেন। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। শেষ পর্যন্ত নজরুল বয়াতিই হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হন।
এই ঘটনায় এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, “আমরা ভেবেছিলাম মেয়েটিকে বাইরে কেউ হত্যা করেছে। কিন্তু নিজ পরিবারই যে এমন নিষ্ঠুর ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।”
পূর্ববর্তী ঘটনাবলি
উর্মী ইসলাম স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত। সহপাঠীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক পরিবার মেনে নেয়নি। এ নিয়ে কয়েকবার ঝগড়া-বিবাদ হয়। ঘটনার দিনও একই কারণে পরিবারের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল বলে তদন্তে জানা গেছে।
এমন পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার ঘটনা দেশে নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই প্রেমঘটিত বা সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে কিশোর-কিশোরী হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে সচেতনতা ও পারিবারিক সহমর্মিতার অভাব এ ধরনের অপরাধকে বাড়িয়ে তুলছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর থেকে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রতিবেশীরা জানান, উর্মী ভদ্র ও মেধাবী ছাত্রী ছিল। তার অকাল মৃত্যুতে স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ঘটনাটিকে নৃশংস উল্লেখ করে দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশের অবস্থান
পুলিশ জানিয়েছে, মামলা ও তদন্তের সব কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তারা বলছে, আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
সহকারী পুলিশ সুপার বলেন, “এ ধরনের অপরাধ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবারই যখন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকে, তখন তা আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। আমরা দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনায় পরিবার ও সমাজ উভয়েরই দায়িত্ব আছে। সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহমর্মিতা না থাকলে ছোটখাটো দ্বন্দ্বও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তারা মনে করেন, কিশোর-কিশোরীদের প্রতি সহনশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ জরুরি, যাতে তারা নিজের কথা পরিবারের কাছে খুলে বলতে পারে।
একজন অপরাধবিজ্ঞানী বলেন, “পারিবারিক সহিংসতা কমানোর জন্য শুধু আইন প্রয়োগ নয়, সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। নইলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড রোধ করা সম্ভব হবে না।”
পরিশেষে
উর্মী হত্যার ঘটনায় বাবাসহ পরিবারের তিন সদস্যের স্বীকারোক্তি সমাজে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যে বাবা নিজেই মামলা করে বিচার চাইছিলেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত খুনের আসামি। এখন প্রশ্ন হলো, এ ঘটনা থেকে সমাজ কতটা শিক্ষা নেবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে পরিবারগুলো কতটা সচেতন হবে।
এম আর এম – ১০৬৫, Signalbd.com



