নামাজরত অবস্থায় অন্তঃস্বত্বা মাহাবুবাকে খুন করে শাশুড়ির ভাড়াটে খুনিরা: পুলিশ

চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় ঘটেছে হৃদয়বিদারক এক হত্যাকাণ্ড। নামাজরত অবস্থায় গৃহবধূ মাহাবুবা আক্তারকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানিয়েছে, হত্যার নেপথ্যে ছিল পারিবারিক কলহ এবং পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। মূলত শাশুড়ির ভাড়াটে খুনিদের মাধ্যমেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
ঘটনার বিস্তারিত
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভিকটিম মাহাবুবা আক্তার ছিলেন অন্তঃস্বত্বা এবং ঘটনার দিন (১৬ জুলাই ২০২১) বিকেলে তিনি জুমার নামাজ আদায় করছিলেন। সে সময় কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তি বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পালিয়ে যায়। শুরুতে বিষয়টি ‘অজ্ঞাত হামলাকারীর কাজ’ বলে মনে হলেও দীর্ঘ তদন্তে উঠে আসে ভিন্ন চিত্র।
পিবিআইর টিম গত ২৪ আগস্ট চট্টগ্রামের বায়জিদ থানার হাজীপাড়া বেলতলা এলাকা থেকে মো. আরিফ (৩৫) নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ছিলেন নিহতের শাশুড়ির পরিচিত ও তাদের বাসার ভাড়াটিয়া। জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ হত্যাকাণ্ডে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন।
পারিবারিক কলহের পটভূমি
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, নিহত মাহাবুবার বিয়ে হয়েছিল তার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই তিনি শ্বশুরবাড়িতে নানা নির্যাতনের শিকার হন। স্বামী ও শাশুড়ি তাকে প্রায়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন করতেন। এ ধরনের নির্যাতনের কারণে পারিবারিক অশান্তি চরমে পৌঁছায়। অবশেষে শাশুড়ি নাজনিন বেগম, ভাড়াটিয়া আরিফের মাধ্যমে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে পুত্রবধূকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
কীভাবে সাজানো হয়েছিল হত্যার ফাঁদ
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, নাজনিন বেগম তার ভাড়াটিয়া আরিফকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন জুমার নামাজের সময় ঘরে প্রবেশ করা সহজ হবে ভেবে হামলাকারীরা ঢুকে পড়ে। মাহাবুবা নামাজরত থাকায় তিনি আত্মরক্ষার সুযোগই পাননি। খুনিরা শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
আরিফ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেন যে, তিনি নিজে একাই নন, বরং আরও তিনজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে এই হত্যায় অংশ নেন। এ ছাড়া পরিকল্পনার মূল হোতা ছিলেন শাশুড়ি নাজনিন বেগম।
মামলার অগ্রগতি ও তদন্তের ধাপ
প্রথমে ইপিজেড থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে প্রায় দেড় বছরের মধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। কিন্তু নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে। আধুনিক প্রযুক্তি, কল ডিটেইলস ও গোয়েন্দা তথ্য কাজে লাগিয়ে অবশেষে মূল আসামি আরিফকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়।
পিবিআই জানায়, অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মামলার পূর্ণাঙ্গ চার্জশিট প্রস্তুতির কাজ চলছে এবং আদালতে দ্রুতই তা জমা দেওয়া হবে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
অন্তঃস্বত্বা অবস্থায় এক নারীকে এমন নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা স্থানীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি শুধু পারিবারিক নির্যাতনের একটি দৃষ্টান্ত নয়, বরং নারীর নিরাপত্তাহীনতার বড় উদাহরণ। বিশেষ করে গৃহবধূদের ওপর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতামত
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পারিবারিক কলহ ও সম্পত্তিগত বিরোধ প্রায়ই হত্যাকাণ্ডে রূপ নিচ্ছে। যদি সমাজে সচেতনতা ও আইনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও কার্যকর হতো, তবে এমন ঘটনা কমে যেত। পিবিআই কর্মকর্তারা বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার ও গোয়েন্দা তৎপরতার ফলে হত্যার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে।
চট্টগ্রামের এই হত্যাকাণ্ড কেবল একটি পরিবারের নয়, পুরো সমাজের জন্য বড় সতর্কবার্তা। পারিবারিক নির্যাতন থেকে শুরু করে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত—সব কিছুর মূলেই রয়েছে অমানবিক মানসিকতা। এখন প্রশ্ন হলো, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই মামলার বিচার দ্রুত শেষ হবে কি না, এবং দোষীরা কি যথাযথ শাস্তি পাবে?
এম আর এম – ১০৪৭, Signalbd.com