ট্রাম্পের শুল্ক নীতি, পাকিস্তানে সর্বনিম্ন, ক্ষতি বেশি কারা?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের নীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ২ তারিখ ‘লিবারেশন ডে’ নামে ঘোষণা দিয়ে শুরু হওয়া এই শুল্ক আরোপের প্রক্রিয়া জুলাই মাসে আরও জোরদার হয়েছে। ট্রাম্প ৩১ জুলাই ৯০টিরও বেশি দেশের ওপর নতুন শুল্কহার ঘোষণা করেছেন, যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ আছে। শুল্কের হার সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শুল্কের সর্বনিম্ন হার পাকিস্তানে
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তানের ওপর আরোপিত শুল্ক সবচেয়ে কম, মাত্র ১৯ শতাংশ। পাকিস্তানের মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশই টেক্সটাইল শিল্প থেকে, যার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। তুলনামূলক কম শুল্ক পাকিস্তানের তৈরি পোশাক খাতকে বড় সুবিধা দিতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে উষ্ণায়িত হয়েছে; এমনকি পাকিস্তান গত জুন মাসে ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছিল। এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলে পাকিস্তানের জন্য মার্কিন বাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে।
ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের অবস্থান
ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা এপ্রিল মাসে প্রস্তাবিত ২৭ শতাংশের তুলনায় কিছুটা কম। ভারতের ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র “অনির্দিষ্ট জরিমানা” ধার্য করেছে। ভারতের ওপর এই শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে জটিল করেছে।
বাংলাদেশও বর্তমানে ১৯ থেকে ২০ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কারও শুল্ক এই একই পরিসরে রয়েছে।
বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য আলোচনায় এগিয়ে গিয়ে ৪৬ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামাতে সক্ষম হয়েছে। এটি অন্যান্য দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিন্নমত ও প্রভাব
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ওপর শুল্কের হার ভিন্ন। লাওস ও মিয়ানমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যেখানে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকারের সীমাবদ্ধতা, ক্রয়ক্ষমতার কমতি এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই শুল্ক বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে শুল্ক হার অপরিবর্তিত রয়েছে, মাত্র ১০ শতাংশ, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বেশি করে রপ্তানি কম করে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর বাণিজ্য পরিস্থিতি
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও অস্ট্রেলিয়া মার্কিন মিত্র দেশ হিসেবে তুলনামূলক ভালো অবস্থায় আছে। বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি ও সেমিকন্ডাক্টর পণ্যের ওপর শুল্ক হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হয়, যা ট্রাম্প “ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি” বলে অভিহিত করেন। তাইওয়ানের শুল্ক ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে, যদিও তাদের চিপ শিল্পের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ হতে পারে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক
চীনের নাম যদিও সর্বশেষ শুল্ক ঘোষণায় নেই, তবে দুই দেশের বাণিজ্য আলোচনা চলমান রয়েছে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর ও প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণের প্রতিবাদ করে বিরল খনিজ সরবরাহের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ফেন্টানিল উৎপাদন কমাতে, মার্কিন কোম্পানির বাজার প্রবেশাধিকারে সহায়তা করতে এবং মার্কিন কৃষি পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করতে চায়। দুই দেশ বাণিজ্য যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ৯০ দিন বাড়িয়েছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য দেশ ও শুল্ক হার
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশ যেমন আফগানিস্তান, ফিজি, নাউরু, পাপুয়া নিউ গিনি ১৫ শতাংশ শুল্কের মধ্যে রয়েছে। কাজাখস্তানের শুল্ক হার ২৫ শতাংশ। তবে এই হারগুলো চূড়ান্ত নয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যে কোন সময় শুল্ক হার পরিবর্তনের স্বাধীনতা রাখেন।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য ও ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা
হিনরিচ ফাউন্ডেশনের বাণিজ্য নীতির প্রধান ড. ডেবোরাহ এলমস বলেন, মার্কিন শুল্ক হার পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছে। এটি পরিস্থিতি অনুযায়ী শুল্কের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানোর পথ সুগম করে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির এই নতুন সংস্করণে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। পাকিস্তান তুলনামূলক সুবিধা পেলে, ভারতের মতো দেশগুলোকে বড় চাপ মোকাবিলা করতে হতে পারে। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশের কৌশলগত পদক্ষেপ তাদের ক্ষতি কমাতে সহায়ক হবে।
শুল্ক নীতি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও সম্পর্কের ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলবে। এ জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন নিজেদের অর্থনৈতিক নীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং বহুমাত্রিক বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করা।
MAH – 12072, Signalbd.com