বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে আগুন লাগার পর সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজন প্রাণ হারান। স্থানীয়দের অভিযোগ, ট্রান্সফরমার সমস্যার কথা জানালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে অবহেলার দায় প্রশ্ন তুলেছে এলাকাবাসী।
ঘটনাস্থলে মৃত্যু — একসঙ্গে নিথর হয়ে গেল তিন জীবন
বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের রাংলাই চেয়ারম্যান পাড়ায় রাত গভীর হতেই নামে এক শোকের ছায়া। রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে আগুন লাগে, আর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে একসঙ্গে প্রাণ হারালেন দাদি, নাতনি এবং পরিবারের আরেক নারী সদস্য।
মৃতরা হলেন—৭১ বছর বয়সী উরকান ম্রো, তার ১৭ বছর বয়সী নাতনি তুমলে ম্রো এবং ৩৫ বছর বয়সী রিয়েন ম্রো ওরফে রওলেং।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনাটি?
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাতে প্রবল বৃষ্টির সময় শর্টসার্কিট হয়ে পাড়ার বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমারে আগুন ধরে যায়। সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ঘরে থাকা ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিতে। ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে যখন সবাই সুইচ বন্ধ করতে ছুটে আসেন, তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।
উরকান ম্রো ও তার নাতনি ঘুমাচ্ছিলেন। আগুন ও শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে যান, কিন্তু সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে দুজনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েন। একই সময় ঘরের বাইরে থাকা রিয়েন ম্রোও মেইন সুইচ বন্ধ করতে গেলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো পাড়ায়, আতঙ্কে রাত কাটে
ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুরো পাড়ার প্রতিটি ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে গিয়েছিল। ইলেকট্রিক বোর্ড, চার্জার, ভেন্টিলেটর এমনকি ফ্রিজ ও টিভিতেও আগুন ধরে যায়। পুরো এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ও চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময় অন্তত আরও ৫-৬ জন আহত হন, যাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আগে থেকেই ট্রান্সফরমারে সমস্যা ছিল — স্থানীয়দের ক্ষোভ
পাড়াবাসীদের দাবি, তারা বহুদিন ধরেই ট্রান্সফরমারের সমস্যার কথা বিদ্যুৎ অফিসে জানিয়ে আসছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা রংরাও ম্রো বলেন,
“বিদ্যুৎ অফিসে বার বার বললেও তারা টাকা ছাড়া কাজ করতে চায় না। শেষমেশ কয়েকটি পাড়ার লোক মিলে টাকা দিয়ে রবিবার বিকেলে মেরামতের জন্য ডাকেন। তারা এসে তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা করে চলে যায়।”
রাতেই ঘটে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এতে করে বিদ্যুৎ বিভাগের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।
দুর্গম এলাকার অবহেলা — প্রশাসনের কী ভূমিকা?
বান্দরবানের পাহাড়ি রাংলাই চেয়ারম্যান পাড়ায় বসবাস করেন প্রায় ২৭টি ম্রো পরিবার। এলাকাটি বিদ্যুৎ সেবায় বরাবরই পিছিয়ে। ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুৎ লাইন রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়ম ও অবহেলা দীর্ঘদিনের অভিযোগ।
স্থানীয়রা বলছেন,
“পাহাড়ি মানুষ হিসেবে আমরা অনেক কিছুতেই ধৈর্য ধরেছি, কিন্তু এমন প্রাণঘাতী ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।”
এ ঘটনায় প্রশাসনের তরফে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য না মিললেও, জেলা প্রশাসক ও পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন বলে জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য
বান্দরবান ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ জানিয়েছেন,
“ট্রান্সফরমারের সমস্যার কারণে পুরো পাড়ার ঘরগুলো বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। মানুষজন সচেতন না থাকায় সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে একে একে মারা যান তিনজন।”
তিনি আরও বলেন, দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এমন মৃত্যু কি এড়ানো যেত?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা যেসব জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ — সেখানে সময়মতো নজরদারি জরুরি।
এ বিষয়ে একজন স্থানীয় সাংবাদিক বলেন,
“এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পাহাড়ি এলাকায় অবহেলার কী পরিণতি হতে পারে।”
সারসংক্ষেপ
একটি ট্রান্সফরমারের আগুন কেড়ে নিল একসঙ্গে তিনটি প্রাণ। যাদের একজন বৃদ্ধা, একজন কিশোরী ও একজন গৃহবধূ। এই ঘটনাটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের অবহেলা, অব্যবস্থা ও দায়িত্বহীনতার প্রতিচ্ছবি।
প্রশ্ন উঠছে—কতবার বলার পর ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ? আরও কত প্রাণ হারালে জবাবদিহি শুরু হবে?



