মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিমমাঠ বাঘাবাড়ি এলাকায় ফেরিওয়ালা জাকির শেখকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে চুরির অপবাদে নির্মম নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে। খেজুরগাছের কাঁটা ও সুই দিয়ে তাঁর দুই চোখ নষ্ট করার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাকিরের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয়দের হাতে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ
পরিবারের সদস্যদের দাবি, গত শনিবার রাত সাড়ে ছয়টার দিকে শতাধিক স্থানীয় লোক হঠাৎ বাড়িতে প্রবেশ করে জোর করে জাকিরকে তুলে নিয়ে পাশের একটি খোলা স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে চুরির মিথ্যা অভিযোগে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং চোখে ধারালো বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জাকিরের চোখের ৮০ শতাংশ দৃষ্টি ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।
ঘটনার পেছনে
স্থানীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি এলাকায় কয়েকটি ছিঁচকে চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে স্থানীয় কয়েকজন যুবক নিয়মিত পাহারা দিচ্ছিলেন। শনিবার রাত একটার দিকে এক যুবককে চোর সন্দেহে আটক করা হয়। পরে তাঁর ‘স্বীকারোক্তির’ ভিত্তিতে জাকিরের নাম উঠে আসে বলে অভিযোগ অভিযুক্তদের। তবে জাকিরের পরিবার দাবি করছে, এটি পূর্বশত্রুতার জেরে পরিকল্পিত হামলা।
পরিবারের আর্তনাদ
জাকিরের স্ত্রী ঝিনুক বেগম সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার স্বামী নির্দোষ। দুই বছর আগে একটি ঘটনার জেরে আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল কয়েকজন। এবার তারা চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে স্বামীকে অন্ধ করে দিয়েছে। নয়টি সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে।”
তিনি জানান, স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন এবং অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মন্তব্য
শিরখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সোহাগ মাতুব্বর বলেন, “জাকির আমার এলাকার ভোটার। জীবনে কখনো তাকে কোনো খারাপ কাজে জড়াতে দেখিনি। যখন ঘটনা ঘটে, তখন উৎসুক জনতার ভিড়ে কিছু করার সুযোগ পাইনি। পুলিশ এসে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে ব্যক্তিগত ক্ষোভও থাকতে পারে। কারণ যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে, তা কেবল চুরির সন্দেহে হয় না।”
অভিযুক্তদের বক্তব্য
অভিযুক্ত কোহিনুর মাতুব্বর ও কামাল হোসেন দাবি করেছেন, “প্রথমে আটক হওয়া যুবকের মুখে জাকিরের নাম শুনেই তাকে ধরা হয়। ব্যক্তিগত শত্রুতার কিছু নেই। সাম্প্রতিক চুরির ঘটনায় লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে এ কাজ করেছে।”
তবে স্থানীয়দের একাংশ মনে করছেন, এ ঘটনার পেছনে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ভূমিকা আছে।
পুলিশের অবস্থান
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, “চুরি করতে গিয়ে কেউ আটক হলেও তাকে মারধর করার অধিকার কারও নেই। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পূর্বশত্রুতার জেরে জাকিরের চোখ নষ্ট করা হয়েছে, তবে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে। ঘটনার সব দিক আমরা তদন্ত করছি।”
ঘটনার সামাজিক প্রভাব ও আইনি দিক
আইনজ্ঞরা বলছেন, চুরির সন্দেহ হলেও গণপিটুনি ফৌজদারি অপরাধ। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, কারণ যেকোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে ‘চুরি সন্দেহ’ হিসেবে উপস্থাপন করে এভাবে হামলা চালানোর ঘটনা অন্যদেরও ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
সারসংক্ষেপ
জাকিরের দুই চোখ রক্ষায় চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে আশঙ্কা রয়ে গেছে দৃষ্টিশক্তি হারানোর। পরিবার ও স্থানীয় সচেতন মানুষদের দাবি, এ ঘটনার দ্রুত বিচার হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এভাবে আইন হাতে তুলে নিতে সাহস না পায়।
এম আর এম – ০৮১৪, Signalbd.com



