রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবে মদ বিক্রির ওপর বিধি-নিষেধ আরও শিথিল করা হয়েছে। দেশটিতে বসবাসরত অমুসলিম বিদেশিরা এখন সহজেই পানীয় কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। কেবল কয়েক দিন আগেই প্রথমবারের মতো কূটনীতিক নন এমন ব্যক্তিরা মদ কেনার অনুমতি পেয়েছিলেন। সম্প্রতি নীরবে নিয়ম শিথিল করার পর, মাসে অন্তত ৫০ হাজার রিয়াল আয় করেন—এমন অমুসলিম বিদেশি বাসিন্দারা এখন রিয়াদে দেশের একমাত্র মদের দোকান থেকে পানীয় কিনতে পারছেন। এই পদক্ষেপটি সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে সামাজিক সংস্কার এবং পশ্চিমা বিনিয়োগ আকর্ষণ করার প্রচেষ্টার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই বিধিনিষেধ শিথিলের খবর প্রবাসী কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বিধিনিষেধ শিথিলতা: নীরবে বড় পরিবর্তন
সৌদি আরবের রাজধানীতে এই বিধিনিষেধ শিথিলের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল গত মাসের শেষ দিকে। প্রথমে ‘প্রিমিয়াম ভিসা’ ধারীদের রিয়াদে মদ কেনার অনুমতি দেওয়া হয়। এর ফলে রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত মদের দোকানটি থেকে এই প্রথম কূটনীতিক নন এমন বিদেশি বাসিন্দারা মদ কেনার সুযোগ পান। তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নিয়ম আরও শিথিল করা হয়েছে বলে এএফপির সঙ্গে কথা বলা একাধিক প্রবাসী নিশ্চিত করেছেন।
ক্রেতারা জানান, তাঁরা দোকানের কর্মীদের কাছে নিজেদের আবাসিক কাগজপত্র জমা দেন। এরপর কর্মীরা একটি সৌদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাঁদের বেতনের তথ্য যাচাই করেন। মাসে অন্তত ৫০ হাজার রিয়াল আয় করেন—এমন অমুসলিম বিদেশি বাসিন্দারা এই যাচাই প্রক্রিয়ার পর সফলভাবে মদ কিনতে পারছেন।
প্রবাসীদের প্রতিক্রিয়া: অবিশ্বাস থেকে উল্লাস
বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার খবরটি প্রবাসীদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। এক প্রবাসী এএফপিকে বলেন, ‘আমরা অবাক হয়েছি এবং শুরুতে বিশ্বাসই করতে পারিনি।’ যাচাই করার পর সফলভাবে মদ কিনতে পেরে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেন।
রিয়াদে বসবাসকারী আরেক প্রবাসী নারী তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘খবরটা শুনে আমাদের আশপাশের মানুষজন যেন পাগল হয়ে গেল—যেন তারা আগে কখনো মদ চেখেই দেখেনি!’ এই প্রতিক্রিয়া সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে মদ বিক্রির ওপর থাকা কঠোর নিষেধাজ্ঞার মাঝে প্রবাসীদের জন্য এই ধরনের শিথিলতার গুরুত্ব তুলে ধরে। রিয়াদের ওই মদের দোকানে বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলেও সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
প্রিমিয়াম ভিসা ও ক্রেতার সংখ্যা
সৌদি আরবের প্রিমিয়াম রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস বা প্রিমিয়াম ভিসা একটি নির্বাচিত গোষ্ঠীর বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য। ২০১৯ সালে চালু হওয়া এই ভিসা পেতে হলে বিভিন্ন শর্ত পূরণের পাশাপাশি আবেদনকারীকে এককালীন আট লাখ রিয়াল পরিশোধ করতে হয়। এই প্রিমিয়াম ভিসাধারীরাই মূলত মদের দোকান থেকে কেনার প্রাথমিক অনুমতি পেয়েছিলেন।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এক সূত্র জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রথম ধাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি প্রিমিয়াম ভিসাধারী বাসিন্দা ওই দোকান থেকে কেনাকাটা করেছেন। এই সংখ্যা থেকেই বোঝা যায়, এই ধরনের সুবিধা প্রবাসীদের মধ্যে কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল। এই পদক্ষেপটি উচ্চ আয়ের এবং দক্ষ অমুসলিম বিদেশিদের সৌদি আরবে বসবাস ও কাজ করার জন্য উৎসাহিত করবে।
ভিশন ২০৩০ এবং সামাজিক সংস্কার
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষিত ভিশন ২০৩০ অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির একটি অংশ হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। এই সংস্কারের লক্ষ্য হলো তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে এসে পর্যটন, বিনোদন এবং বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। মদ বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ শিথিলতা সেই বৃহত্তর সামাজিক সংস্কারের অংশ।
রক্ষণশীল সামাজিক নিয়মগুলো শিথিল করার মাধ্যমে সৌদি আরব বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা বিনিয়োগকারী এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের আকর্ষণ করতে চাইছে। কারণ, অনেক বিদেশি কর্মীই উন্নত জীবনযাত্রার মানের জন্য এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করেন। যদিও এই পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে আসছে, তবুও রক্ষণশীল রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরবের জন্য এটি একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যান্য শহরে দোকান খোলার পরিকল্পনা
বর্তমানে রিয়াদের কূটনৈতিক এলাকায় একটি মাত্র মদের দোকান থাকলেও, ভবিষ্যতে সৌদি আরবের অন্যান্য বড় শহরেও আরও মদের দোকান খোলার বিষয়ে নানা প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে অবগত এক সূত্র জানিয়েছে, ২০২৬ সালে জেদ্দা ও ধাহরানে মদের দোকান খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য বা নির্দিষ্ট বিবরণ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
জেদ্দা ও ধাহরানের মতো বাণিজ্যিক ও শিল্প শহরগুলোতে মদের দোকান খোলা হলে তা আরও বেশি সংখ্যক প্রবাসী ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। এটি সৌদি আরবের পর্যটন খাতকে আরও চাঙ্গা করতে সহায়ক হবে।
একটি নতুন দিগন্তের সূচনা
মদ বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করা সৌদি আরবের ইতিহাসের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এই পদক্ষেপটি দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে একটি বড় অগ্রগতি। অমুসলিম প্রবাসীদের জন্য এই সুযোগ সৃষ্টি সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রাকে সমর্থন করবে এবং দেশটিকে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে আরও বেশি সমন্বয় করতে সাহায্য করবে। তবে এই ধরনের সংস্কারগুলো ধর্মীয় ও রক্ষণশীল সমাজে কী ধরনের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এম আর এম – ২৪৫৩,Signalbd.com



