আঞ্চলিক

চট্টগ্রামে উন্মুক্ত নালায় তলিয়ে গেল শিশুর প্রাণ

চট্টগ্রামের হালিশহরে উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা গেল তিন বছরের শিশু মরিয়ম। স্ল্যাববিহীন, পানিতে ঢাকা নালায় পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় সে। ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধার করলেও বাঁচানো যায়নি শিশুটিকে। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া এবং ক্ষোভ দুই-ই।

এক মুহূর্তেই নিভে গেল ছোট্ট প্রাণ

চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর থানার আনন্দপুর এলাকায় বুধবার (৯ জুলাই) দুপুর ৩টার দিকে ঘটে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা। তিন বছরের শিশু মরিয়ম বাড়ির পাশের একটি দোকানে যাওয়ার সময় পানিতে ঢাকা একটি উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায়। দ্রুত ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধার করলেও তাকে আর বাঁচানো যায়নি।

কিভাবে ঘটল দুর্ঘটনাটি?

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘটনাস্থলে নালার স্ল্যাবটি মেরামতের জন্য খুলে রাখা হয়েছিল। উপরিভাগে পানি জমে থাকায় এটি আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল না। এই অসতর্কতা ও অব্যবস্থাপনাই হয়ে ওঠে মর্মান্তিক পরিণতির কারণ।

শিশুটি মা’কে বলে দোকানে যাচ্ছিল। পথিমধ্যেই পানিতে ঢাকা সেই উন্মুক্ত নালায় পা রাখতেই মুহূর্তে স্রোতের টানে তলিয়ে যায় সে।

উদ্ধার অভিযান: শেষ চেষ্টা

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশন থেকে ডুবুরি টিম পৌঁছে যায়। বিকেল ৩টা ৫৪ মিনিটে মরিয়মকে উদ্ধার করা হয়। সাথে সাথে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে ডুবুরি দল পাঠাই। উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে শিশুটিকে আর ফেরানো যায়নি।”

এমন মৃত্যু চট্টগ্রামে নতুন নয়

চট্টগ্রাম শহরের নালা-নর্দমার দুরবস্থা বহুদিনের। এর আগেও উন্মুক্ত বা সুরক্ষা-হীন নালায় পড়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

  •  এপ্রিল ২০২৫: রিকশা থেকে পড়ে এক শিশু সেহরিস খালে তলিয়ে যায়।
  •  সেপ্টেম্বর ২০২১: বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়া হাঁটতে গিয়ে উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা যান।
  •  ডিসেম্বর ২০২১: শিশু কামাল নিখোঁজ হয়, তিন দিন পর উদ্ধার হয় তার মরদেহ।

এই ঘটনাগুলো যেন নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এলাকাবাসীর ক্ষোভ: “আমাদের সন্তানেরা কি এমন মৃত্যুই পাবে?”

শিশু মরিয়মের মৃত্যুতে এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “শিশুরা তো খেলার ছলে যেকোনো দিকে চলে যায়। এই অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের গাফিলতির কারণেই আমাদের সন্তানেরা মারা যাচ্ছে।”

স্থানীয় কাউন্সিলরের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনেছেন অনেকে। বছরের পর বছর ধরে একই রকম উন্মুক্ত নালা ঝুঁকি তৈরি করলেও কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি বলে দাবি তাদের।

নগর ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) মাঝে মাঝে মেরামতের কাজ করে থাকলেও, কোনো এলাকায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ নাগরিকদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনঘনত্বপূর্ণ এলাকায় যেকোনো মেরামতকাজ করার সময় সাময়িকভাবে হলেও সুরক্ষা ব্যারিকেড বা স্ল্যাব বসানো বাধ্যতামূলক করা উচিত।

নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, “নগর ব্যবস্থাপনায় যখন জননিরাপত্তা উপেক্ষিত হয়, তখন এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতেই থাকবে।”

পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। নিহত শিশুটির পরিবার এখনো শোকে বাকরুদ্ধ। এলাকাবাসী দ্রুত দোষীদের শাস্তি ও নালার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন।

❝ “এই মৃত্যু আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি” —একজন নাগরিক ❞

মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে?

একটি শহর, যেখানে শিশুদের নালায় পড়ে মৃত্যু যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে — সেটি কোনো সভ্য নগর হতে পারে না। চট্টগ্রাম শহরের নালা-নর্দমা অব্যবস্থাপনার প্রতীক হয়ে উঠছে। এখন সময় দায়িত্বশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।

প্রশ্ন রয়ে যায় — শিশু মরিয়মের মতো আর কত প্রাণ হারালে জেগে উঠবে প্রশাসন?

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button