আঞ্চলিক

ভাড়া দিতে বিলম্ব, মা-ছেলেকে ঘরবন্দি করে দরজায় তালা দিলো মালিক!

Advertisement

মাত্র ৩ দিনের বিলম্বে বাসা ভাড়া না দেওয়ায় দরজায় বাইরে থেকে তালা মেরে ঘরবন্দি করে রাখা হলো এক মা ও তার ছেলেকে। ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জ শহরে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পুলিশ এসে উদ্ধার করে পরিবারটিকে।

ঘটনাস্থলে যা ঘটেছে

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের রায়পাড়া এলাকায় অবিশ্বাস্য এক অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। গত মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সকালে বাসা ভাড়া দিতে মাত্র তিন দিন দেরি হওয়ায় মা জবা রানী বর্মন ও ছেলে ইমন বর্মনকে ঘরের ভেতরে রেখে বাহির থেকে তালা মেরে দেন বাড়ির মালিক ইউসুফ চৌধুরী।

ইমন জানায়, তাদের বাসার মাসিক ভাড়া ৬,৬০০ টাকা। গত জুন মাসের ভাড়া ৫ জুলাইয়ের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও আর্থিক সংকটে হাতে টাকা না থাকায় কিছুদিন সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু মালিক কোনো কথা না শুনে ৬ জুলাই গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেন এবং ৮ জুলাই সকালে বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে চলে যান।

ভুক্তভোগী পরিবারের করুণ কাহিনী

ইমন বর্মন একজন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা রামপ্রসাদ বর্মনের মৃত্যুর পর থেকে সংসারের হাল ধরেছে সে-ই। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঝাল-মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালানো এবং পড়াশোনার খরচ চালায় সে। ইমনের মা জবা রানী জানান, কয়েকদিন আগে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল, যার কারণে কিছুটা আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়। সে কারণে সময় চেয়েছিলেন।

ঘরে আটকে পড়ার পর ইমন জানালা দিয়ে প্রতিবেশীদের জানান এবং আত্মীয়দের ফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে আত্মীয়রা থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালে দুপুর দুইটার দিকে পুলিশ এসে তালা খুলে দেয় এবং গ্যাস সংযোগ পুনরায় চালু করে।

প্রতিবেশীদের ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া

প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম বলেন, “ঘরের ভেতর মানুষ রেখে বাইরে তালা মারা কখনও কল্পনাও করিনি। মাত্র তিন দিন বিলম্বে এমন কাজ? এটা কি মানবিক?”
আরেক ভাড়াটিয়া স্বপন চন্দ্র বলেন, “আমরা চিৎকার শুনে এসে দেখি দরজায় তালা। এরকম অমানবিক আচরণ আমরা জীবনে দেখিনি।”

মালিকের অবস্থান ও পরবর্তী পদক্ষেপ

বাড়ির মালিক ইউসুফ চৌধুরী সরাসরি গণমাধ্যমে বক্তব্য না দিলেও পুলিশ ও স্থানীয়দের কাছে জানান, “ভাড়াটিয়ারা সময়মতো বিল না দিলেও আমি বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল সময়মতো দিতে বাধ্য। এক বছর আগেই নোটিশ দিয়েছি বাসা ছেড়ে দিতে।”

তবে ঘটনার পরে বিকেল চারটার দিকে তিনি ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসের ভাড়া মওকুফ করছেন এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। পরিবারটি এতে সম্মতি দেয়।

পুলিশের বিবৃতি ও মানবিক অবস্থান

সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু কালাম বলেন, “বাহির থেকে ঘরের দরজায় তালা মারা একটি অমানবিক ও বেআইনি কাজ। বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পাঠিয়ে তালা খোলা হয়েছে।”

আগের ঘটনা ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনা শুরু হয়। অনেকে ঘটনাটিকে ‘অমানবিক ও নিষ্ঠুর’ বলে উল্লেখ করেন।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “যেখানে একজন শিক্ষার্থী জীবনের সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই করছে, সেখানে বাড়িওয়ালার এই আচরণ অমানবিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ।”

বিশ্লেষণ ও মানবিক বার্তা

এই ঘটনাটি কেবল একটি ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালার মধ্যকার বিরোধ নয়—বরং এটি সমাজে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি প্রতিচ্ছবি। একদিকে রয়েছে এক ছাত্রের অমানুষিক সংগ্রাম, অন্যদিকে অল্প দেরিতে ভাড়া না পেয়ে চরম ব্যবস্থায় যাওয়া বাড়িওয়ালা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনা আইনি ও নৈতিক উভয়দিক থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর প্রতি আরও সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ জরুরি।

“ঘরের ভেতরে মানুষ রেখে বাইরে তালা মেরে দেওয়া অমানবিক এবং আইনের পরিপন্থী”—ওসি আবু কালাম, সুনামগঞ্জ মডেল থানা

সুনামগঞ্জের এ ঘটনাটি কেবল একটি ক্ষণস্থায়ী খবর নয়—এটি একটি বড় প্রশ্ন তোলে আমাদের সমাজে সহানুভূতি, মানবতা ও সহনশীলতার অবস্থান নিয়ে। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য প্রশাসনিক নজরদারি ও জনসচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

এম আর এম – ০২৩৪, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button