চট্টগ্রামের রাউজানে বোরকা পরে এসে গুলি করে যুবককে হত্যা

চট্টগ্রামের রাউজানে প্রকাশ্যে দিবালোকে এক যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে বোরকা পরিহিত দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডটি ঘটে বাজারের ব্যস্ত সময়ের মধ্যে, যা এলাকায় ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। নিহত ব্যক্তি স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন, এবং এলাকায় বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের ঈশানভট্টের হাটবাজারে আজ রোববার (৬ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম মুহাম্মদ সেলিম (৪৫), যিনি ইসলামিয়া নতুন পাড়ার আমির হোসেনের ছেলে এবং স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সেলিম হাটে শান্তি ফার্মেসীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় বোরকা পরে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এসে ৪–৬ জনের একটি সশস্ত্র দল তাকে লক্ষ্য করে কাছ থেকে একাধিক গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ সেলিম ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন। আশপাশের লোকজন দ্রুত তাকে উদ্ধার করে রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যার সময় পরিবার ছিল সঙ্গে
জানা গেছে, সেলিম তার এক আত্মীয়ার জানাজা ও দাফন শেষে স্ত্রী ও কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। হাটবাজারে ওষুধ কেনার জন্য থামেন তিনি, ঠিক তখনই ঘটে এই হামলা। তার স্ত্রী ও কন্যার সামনেই দুর্বৃত্তরা গুলি করে পালিয়ে যায়। এই ঘটনাটি এলাকাবাসীকে আরও বেশি হতবাক করেছে, কারণ পরিবারের সামনে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড খুব কমই দেখা যায়।
রাজনৈতিক সংঘাত ও পুরনো দ্বন্দ্ব
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং পুরনো বিরোধ কাজ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি বলেন, “মুহাম্মদ রায়হান নামের একজন সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।”
স্থানীয় রাজনীতিতে দুই গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। নিহত সেলিমকে ‘জানে আলম গ্রুপ’-এর অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
চিকিৎসকদের বক্তব্য
রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. পূজা মল্লিক জানান, সেলিমের মুখের বাঁপাশে একটি গুলি লাগে যা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, অন্য আরেকটি গুলি কোমরে বিদ্ধ হয়। দ্রুত তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করা হয়।
অতীতের সহিংসতার ধারাবাহিকতা
রাউজান এলাকাটি গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকায় মোট ১৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে ১০টি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ফলাফল। প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে শতাধিকবার, এবং তিন শতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
এ ধরনের ঘটনা শুধু রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবিও তুলে ধরছে।
পুলিশের পদক্ষেপ ও তদন্ত
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করেছে এবং মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, “আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি নিচ্ছি এবং সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করছি। খুব শিগগিরই জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে।”
ভবিষ্যতের শঙ্কা ও প্রত্যাশা
এই প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড এলাকাবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ বাজারে যাওয়া নিয়েও শঙ্কিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থানের চর্চা না হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই ধরণের বোরকা পরে সন্ত্রাসীদের চলাফেরা রোধে প্রশাসন কী ভূমিকা নেবে? বাজারে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
“ঘটনার সময় নিহতের স্ত্রী ও কন্যা উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের নির্মমতা একটি সভ্য সমাজে ভাবনার বিষয়” —স্থানীয় একজন বাসিন্দা।
সারসংক্ষেপ
চট্টগ্রামের রাউজানের এই হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির প্রাণহানি নয়, বরং এটি বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাতের আরেকটি উদ্বেগজনক উদাহরণ। তদন্তের অগ্রগতি এবং সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে—এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
এম আর এম – ০১৯৬, Signalbd.com