যশোরে বাস দুর্ঘটনায় দুইজন নিহত: আহত ৩, আটক চালক

যশোর জেলার মনিরামপুরে চাঞ্চল্যকর এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুইজন। আহত হয়েছেন আরও তিনজন। শনিবার (৬ জুলাই) দুপুর ১টার দিকে যশোর-চুকনগর সড়কের মনিরামপুর সরকারি কলেজ মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। যাত্রীবোঝাই একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি ভ্যানকে ধাক্কা দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত ও আহতদের পরিচয়
দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন ভ্যানযাত্রী এবং অন্যজন পথচারী। ভ্যানযাত্রী ছিলেন গাইবান্ধা জেলার শাঘাটা উপজেলার আব্দুল্লাহ পাড়ার বাসিন্দা রতন (২৭)। অন্য নিহত ব্যক্তি হলেন নাজমুল দফাদার (৪০), তিনি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের আবু খালেক দফাদারের ছেলে।
আহত তিনজনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আহতদের মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
কীভাবে ঘটলো দুর্ঘটনাটি?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দুপুরে যশোরমুখী একটি যাত্রীবাহী বাস মনিরামপুর বাজার অতিক্রম করে সরকারি কলেজ মোড়ে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ভ্যানকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ধাক্কায় ভ্যানটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং এক পথচারীকেও চাপা দেয় বাসটি। প্রায় ৩০ মিটার দূর পর্যন্ত গিয়ে বাসটি দাঁড়ায়। এরপর চালক বাসটি ফেলে পালানোর চেষ্টা করলেও বিক্ষুব্ধ জনতা বাসসহ চালককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
স্থানীয় দোকানদার সোহেল হোসেন বলেন,
“আমি দোকানে বসে ছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখি ভ্যানটি রাস্তায় ছিটকে পড়ে আছে, একজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। লোকজন চিৎকার করছে। দ্রুত আমরা সবাই ছুটে যাই। বাসটি থামানোর আগেই একজনকে চাপা দিয়ে চলে যায়। পরে সবাই মিলে বাসটিকে ধাওয়া করে আটক করি।”
পুলিশের বক্তব্য
মনিরামপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বাবলুর রহমান খান বলেন,
“বাসটি আটক করা হয়েছে এবং চালক আব্দুল গনী (৩৫) কে আমরা হেফাজতে নিয়েছি। দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা ও ফায়ার সার্ভিস দ্রুত উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। বর্তমানে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিহতদের মরদেহ যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।”
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ
ঘটনার পরপরই এলাকাবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা সড়কে প্রতিবাদ শুরু করে এবং দায়ী বাস মালিক ও চালকের শাস্তির দাবি জানায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মিনারুল ইসলাম বলেন,
“এই রাস্তায় প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত গতি আর বেপরোয়া চালানোর কারণে আমাদের জীবন হুমকির মুখে। প্রশাসন যদি ব্যবস্থা না নেয়, আমরা আবারও রাস্তায় নামব।”
যশোর-চুকনগর সড়কে দুর্ঘটনার ইতিহাস
এই সড়কটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুট। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক ও ভ্যান এই রাস্তায় চলাচল করে।
তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে এই সড়কে অন্তত ১৮টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং প্রাণ গেছে ২৫ জনের। এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় অতিরিক্ত গতি, প্রশিক্ষণহীন চালক এবং ট্রাফিক আইনের ঘাটতি।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪,০০০ এর বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০২৪ সালে দেশে ৫,০০০-এর বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে প্রাণ হারান প্রায় ৬,০০০ মানুষ।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন হলেও, বাস্তব প্রয়োগে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিত গাড়ি পরিদর্শন, ট্রাফিক পুলিশ বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
প্রশাসনের প্রতি দাবিসমূহ
- সিসিটিভি স্থাপন করে নজরদারি বাড়ানো
- বেপরোয়া চালকদের লাইসেন্স বাতিল করা
- নির্দিষ্ট গতিসীমা নির্ধারণ করে তা কার্যকর করা
- দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক ও মালিকের শাস্তি নিশ্চিত করা
- পথচারীদের জন্য আলাদা ফুটপাত নিশ্চিত করা
মনিরামপুরে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—দেশে সড়ক নিরাপত্তার বাস্তব চিত্র। আমরা কতটা অনিরাপদ অবস্থায় প্রতিদিন চলাফেরা করছি।
সরকার ও প্রশাসনের উচিত, এই ঘটনার সুবিচার নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।