বেনজীরের সেই আলিশান বাড়ির বাসিন্দা এখন কেয়ারটেকার আর দুই কুকুর

এক সময় যেখানে প্রশাসনের তদারকিতে মুখর থাকত পুরো এলাকা, সেই রূপগঞ্জের ডুপ্লেক্স বাড়িটি এখন নীরব ও জনশূন্য। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির অভিযোগে ক্রোক হওয়া সেই বিলাসবহুল বাড়িতে আজ কেবল একজন কেয়ারটেকার ও দুটি কুকুরই থাকছে।
দুর্নীতির মামলায় সম্পত্তি ক্রোকের পর সেখানে থাকছেন না কোনো স্বজন বা প্রশাসনিক প্রতিনিধি—থাকছেন কেবল একজন পুরোনো কেয়ারটেকার ও দুটি পাহারাদার কুকুর।
বাড়ির বর্তমান অবস্থা
সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে নির্মিত এ বাড়িটি ছিল একসময়কার উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আনাগোনার কেন্দ্র। চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা, চলাচলে নিয়ন্ত্রণ, প্রতিবেশীদের উৎকণ্ঠা—সবই ছিল এই বাড়িকে ঘিরে। কিন্তু বর্তমানে এ বাড়ির মূল ফটক দুটি সিলগালা, আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে নিস্তব্ধতা।
বাড়ির চত্বরে রোপণ করা গাছপালার এখন আর নেই আগের যত্ন, ধুলাবালিতে ঢাকা বারান্দা আর ধীরে ধীরে জীর্ণ হয়ে যাওয়া দেয়াল যেন স্মরণ করিয়ে দেয় এক সময়কার দাপটের গল্প।
কে রয়েছেন এখন বাড়িতে?
বাড়িটির দায়িত্বে রয়েছেন কেয়ারটেকার রতন মিয়া, যিনি বেনজীর আহমেদের আমল থেকেই এখানে কর্মরত। তার সঙ্গে রয়েছেন দুটি জার্মান শেফার্ড প্রজাতির কুকুর, যারা একসময় ছিল বাড়ির নিরাপত্তার অংশ। রতন মিয়া জানান, “আমি এখনো এখানে আছি, কিন্তু বাড়ি ক্রোক হওয়ার পর থেকে কোনো বেতন পাচ্ছি না। তবুও জায়গাটার মায়া আমাকে আটকে রেখেছে।”
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়োজিত একজন আনসার সদস্যও আছেন পাহারায়, যিনি আদালতের নির্দেশ অনুসারে বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন।
কিভাবে বাড়িটি সরকারের হাতে গেল?
২০২৪ সালের মে মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অঢেল অবৈধ সম্পদের তথ্য উঠে আসে। এরপর আদালতের আদেশে মোট ৬২৭ বিঘা জমি, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ২৩টি কোম্পানি এবং গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটসহ এই রূপগঞ্জের বাড়িটিও ক্রোক করা হয়।
এই বাড়ির মালিকানা ছিল ‘সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেনজীর আহমেদের সরাসরি সম্পৃক্ততা তদন্তে উঠে আসে, যার ভিত্তিতে বাড়িটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
আগে কেমন ছিল এই বাড়ি?
স্থানীয়রা বলেন, বেনজীর আহমেদ যেদিন এ বাড়িতে রাত্রিযাপন করতেন, তার আগের দিন থেকেই প্রশাসনের জোর তৎপরতা শুরু হতো। এলাকার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো, চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকত। এমনকি সাধারণ মানুষেরও ওই এলাকায় প্রবেশে বাধা ছিল।
প্রতিবেশী মনির হোসেন জানান, “এলাকায় যে হাওয়া বইতো, বুঝা যাইতো বড় কেউ আসতেছে। এখন আর সেই হাওয়া নেই, একেবারে স্তব্ধ সবকিছু।”
জমির বিক্রি নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ
এই জমি একসময় স্থানীয় এক সনাতন পরিবারের ছিল। প্রয়াত প্রেমানন্দ সরকারের ছেলে রামধন সরকার জানান, “আমরা জমি বিক্রি করতে চাইনি। বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের চাপের মুখে বিক্রি করতে বাধ্য হই।”
তিনি আরও জানান, জমি বিক্রির সময় বিঘাপ্রতি এক কোটি টাকায় জমিটি কিনে নেয় ‘আনন্দ হাউজিং সোসাইটি’।
প্রশাসনের তত্ত্বাবধান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমানে বাড়িটি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের অধীনে রয়েছে। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম জানান, “এই বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একজন গ্রামপুলিশ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। ভবিষ্যতে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব হাবিবুল্লাহ জানান, প্রশাসনিক নির্দেশনায় নিয়মিতভাবে বাড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ কী?
যদিও এখনো নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি, তবে বিশ্লেষকদের মতে ভবিষ্যতে এই বাড়ি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সংরক্ষিত সম্পত্তি হিসেবেই রয়ে যাবে অথবা নিলামে তোলা হতে পারে। দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত চলছে, যার প্রভাব এই সম্পত্তির ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
“বাড়িটি ক্রোক হওয়ার পর থেকে আমি কোনো বেতন পাইনি। তবুও বাড়িটির মায়া আমাকে রেখে দিয়েছে”—রতন মিয়া, কেয়ারটেকার
সারসংক্ষেপ
এক সময়কার আলোচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বেনজীর আহমেদের বিলাসবহুল এই ডুপ্লেক্স বাড়িটি এখন যেন এক স্মৃতির প্রতীক। কেয়ারটেকার আর দুই কুকুর ছাড়া সেখানে নেই কোনো কোলাহল, নেই প্রশাসনিক তদারকি। সময়ের সাথে সাথে নীরব এই প্রাসাদ যেন দুর্নীতির এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন থেকে যায়—এমন আরও কয়টি বাড়ি আছে যেগুলোর গল্প আজও অজানা?
এম আর এম – ০১৮০, Signalbd.com