ডেলিভারি করালেন নার্স-আয়া, নবজাতকের মৃত্যুতে তোলপাড় জামালপুরে

জামালপুরের নগর মাতৃসদন কেন্দ্রে চিকিৎসক ছাড়াই নার্স ও আয়ার মাধ্যমে প্রসব করাতে গিয়ে নবজাতকের মর্মান্তিক মৃত্যু। শিশুর গলায় ছিল আঘাতের চিহ্ন। পুলিশ আটক করেছে অভিযুক্ত দুজনকে।ঘটনা জানাজানি হতেই স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
ঘটনার বিস্তারিত
শনিবার (৫ জুলাই) ভোরে শহরের পশ্চিম ফুলবাড়িয়া কলাবাগান এলাকায় জামালপুর পৌরসভার আওতাধীন নগর মাতৃসদন কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রসববেদনা শুরু হলে সোহেল আনসারী নামের এক ব্যক্তি তার স্ত্রী নৌরিন জান্নাত মৌকে নগর মাতৃসদনে ভর্তি করেন।
তবে হাসপাতালটিতে তখন কোনো গাইনি চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না। ফলে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় নার্স শিরিন আক্তার ও আয়া ময়নাকে।
ভোররাতে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হলে, তারা স্বাভাবিক ডেলিভারি করানোর চেষ্টা করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, নবজাতককে টেনে-হিঁচড়ে বের করার সময় শিশুটির গলায় ও শরীরে আঘাত লাগে এবং সে ঘটনাস্থলেই নিথর হয়ে যায়।
স্বজনদের অভিযোগ
নবজাতকের বাবা সোহেল আনসারী বলেন, “হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ছিল না। নার্স ও আয়া মিলে জোর করে সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। বাচ্চার গলা ও শরীরে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন ছিল।”
এ ঘটনায় তিনি চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোর এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার নামান্তর।
পুলিশের হস্তক্ষেপ ও তদন্ত
ঘটনার খবর পেয়ে জামালপুর সদর থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত নার্স শিরিন আক্তার ও আয়া ময়নাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
জামালপুর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু মো. ফয়সল আতিক জানান, “নবজাতক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় আমরা দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছি। মৃত শিশুর সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হাসপাতালের কাঠামো ও পরিচালনা ঘিরে প্রশ্ন
জানা গেছে, নগর মাতৃসদনটি পরিচালিত হচ্ছে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পের আওতায়। এটি জামালপুর পৌরসভার তত্ত্বাবধানে চালিত হলেও গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘদিন ধরে এখানে চিকিৎসা সেবা মানহীন হয়ে পড়েছে। নার্স ও আয়া দিয়ে চিকিৎসা চালানো হচ্ছে, যা মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এখানে চিকিৎসা না, চলছে খামখেয়ালি। গর্ভবতী নারীদের জীবন নিয়ে এমন খেলাধুলা চলতেই পারে না।”
সমাজে প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
ঘটনাটি সামনে আসার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
নাগরিক সমাজ বলছে, “যে প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকই থাকে না, সেখানে কিভাবে প্রসব করানো হচ্ছে? কে নেবে এই মৃত্যুর দায়?”
বাস্তবতা
বাংলাদেশে বিশেষ করে মফস্বল ও জেলা শহরগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে চিকিৎসক সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এতে রোগীরা নার্স, আয়া বা অদক্ষ জনবলের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। আর সে সুযোগেই ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসববেদনা নিয়ে আসা কোনো রোগীকে গাইনি চিকিৎসক ছাড়া ডেলিভারি করানো একেবারেই অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারি ও কাঠামোগত সংস্কারের দাবি জানানো হচ্ছে।
“চিকিৎসক ছাড়া ডেলিভারি করিয়ে আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছে—এর বিচার চাই”—নবজাতকের বাবা সোহেল আনসারী
সারসংক্ষেপ
একটি প্রাণের অপমৃত্যু যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কতটা দুর্বল আমাদের স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই ঘটনার দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
জনগণ চায়, দায়ীদের কঠোর শাস্তি হোক এবং এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে। এক নবজাতকের মৃত্যু যেন আর কোনো পরিবারের জীবনে কালো ছায়া হয়ে না নামে।
এম আর এম – ০১৭১, Signalbd.com