আঞ্চলিক

মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা

 কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামে মাদক চোরাকারবারের অভিযোগ তুলে এক নারীসহ একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয়রা। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।

ঘটনা বিস্তারিত: সকালেই রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার অন্তর্গত আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকালে ঘটে যায় এক ভয়াবহ গণপিটুনির ঘটনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে মাদক চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রামের উত্তেজিত জনতা একই পরিবারের তিনজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। নিহতরা হলেন রুবি বেগম (৫৮), তার ছেলে রাসেল (৩৫) এবং মেয়ে জোনাকি আক্তার (২৭)।

পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে তাদের তীব্র বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং একপর্যায়ে গ্রামবাসীরা তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। নিহতদের লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

পুরনো বিরোধেই রক্তপাত?

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রুবি বেগম ও তার সন্তানরা দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় সন্দেহভাজন মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এর আগেও কয়েকবার তাদের নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এবারে পরিস্থিতি চরমে ওঠে।

গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এক সপ্তাহ আগে গ্রামে একটি চুরি ও মাদক বিক্রির ঘটনা ঘটে, যার জন্য এই পরিবারকে দায়ী করা হয়। তবে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই সাধারণ মানুষ নিজেরাই ‘বিচার’ করতে এগিয়ে আসে, যার ফলাফল ছিল এই মর্মান্তিক মৃত্যু।

পুলিশের বক্তব্য ও তদন্ত অগ্রগতি

বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও ন্যক্কারজনক ঘটনা। আমরা খবর পাওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে যাই এবং তিনটি মরদেহ উদ্ধার করি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, স্থানীয়দের হাতে গণপিটুনিতে তারা নিহত হয়েছেন।”

তিনি আরও জানান, এ বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে এবং যারা এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের শনাক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হচ্ছে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া: আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা

ঘটনার পর স্থানীয়দের অনেকেই জানান, তারা পুলিশের কাছে বারবার অভিযোগ করেও ব্যবস্থা পাননি। তাই তারা নিজেরাই ‘বিচার’ করতে বাধ্য হয়েছেন।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কখনোই কোনো সমাজের জন্য শুভ নয়। এভাবে কোনো সন্দেহভাজনের বিচার জনগণ করতে পারে না। বিচার হওয়া উচিত ন্যায়বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে, প্রমাণ ও সাক্ষীর ভিত্তিতে।

আগে এমন ঘটনা ঘটেছে কি?

এটি কুমিল্লা বা বাংলাদেশের প্রথম গণপিটুনির ঘটনা নয়। এর আগেও বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের ঘটনা দেখা গেছে যেখানে মাদক, চুরি কিংবা ডাকাতির অভিযোগে সন্দেহভাজনদের পিটিয়ে মারা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচারহীনতা ও জনগণের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতার কারণেই এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই প্রবণতা চলতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে সমাজ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করণীয়

বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হলে জনগণের মধ্যে আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত না করার শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি পুলিশেরও দায়িত্ব বাড়াতে হবে — সন্দেহভাজন ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য পেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত যাতে জনগণ আইন হাতে তুলে না নেয়।

“এই ঘটনা আমাদের সমাজে আইনহীনতার ইঙ্গিত দেয়। প্রতিটি নাগরিকের উচিত আইন নিজের হাতে না নেওয়া”— ওসি মাহফুজুর রহমান

সারসংক্ষেপ 

মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা শুধু একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয় — এটি সমাজের বিচারহীনতার এবং জনসচেতনতার অভাবের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।

এখন সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার — সন্দেহভাজন হলেও কি কাউকে এভাবে হত্যা করা উচিত? সমাজ কি ক্রমেই ‘আইন নিজের হাতে নেওয়ার’ দিকে ধাবিত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর এখন সবার জানা দরকার, কারণ পরবর্তী ভিকটিম যে কেউ হতে পারে।

এম আর এম – ০১৬৪, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button