হার্নিয়ার অপারেশন করতে যাওয়া রোগীর অ্যাপেনডিক্স কাটলেন চিকিৎসক!

হার্নিয়ার অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার এক বাসিন্দা। কিন্তু অপারেশনের পরে দেখা গেল, হার্নিয়া থেকে গেছেন অক্ষত, কাটা হয়েছে অ্যাপেনডিক্স! রোগী ও তার পরিবারের অভিযোগ, সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজ করেছেন চিকিৎসক।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নিয়ে আবারও উঠেছে প্রশ্ন। উত্তর ২৪ পরগনার এক ব্যক্তি হার্নিয়া অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেও, শেষ পর্যন্ত কাটা হয়েছে তার অ্যাপেনডিক্স। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর রাজ্যের স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত: হার্নিয়ার চিকিৎসায় ভর্তি, অ্যাপেনডিক্স কাটা
উত্তর ২৪ পরগনার সোদপুরের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ দাস দীর্ঘদিন ধরে হার্নিয়ার সমস্যায় ভুগছিলেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি পানিহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাকে একটি নির্দিষ্ট নার্সিংহোমে রেফার করা হয়, যেখানে এক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়।
অপারেশনের পর রোগী ও তার পরিবার জানতে পারেন, হার্নিয়া নয় বরং অ্যাপেনডিক্স অপসারণ করা হয়েছে। এতে তারা হতবাক হয়ে যান এবং অভিযোগ তোলেন যে, ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পের আওতায় থাকা অর্থ আত্মসাৎ করতেই ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভুল অপারেশন করা হয়েছে।
সরকারি প্রকল্প ও চিকিৎসকের ভূমিকা
‘স্বাস্থ্য সাথী’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প, যার আওতায় দরিদ্র শ্রেণির মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার পেয়ে থাকেন। তবে এই প্রকল্পে নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসার জন্যই অর্থ বরাদ্দ থাকে। হার্নিয়া অপারেশনের খরচ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত না হলেও, অ্যাপেনডিক্স অপসারণের খরচ অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্বজিৎ দাসের পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসক জানতেন যে হার্নিয়ার খরচ প্রকল্পে নেই। তাই তিনি পরিকল্পিতভাবে অ্যাপেনডিক্স অপারেশন দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করেন।
অপারেশনের পরের জটিলতা ও আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট
অপারেশনের কয়েকদিন পর বিশ্বজিৎ দাসের পেটে আবার ব্যথা ও ফোলাভাব দেখা দেয়। তিনি পুনরায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেন এবং আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট করান। সেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, হার্নিয়া অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে এবং তার অ্যাপেনডিক্স অপসারণ করা হয়েছে। এর ফলে রোগী আরও ভয়ে পড়ে যান এবং অভিযোগ জানান স্বাস্থ্য দপ্তরে।
প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া: তদন্তে নামছে স্বাস্থ্য বিভাগ
উত্তর ২৪ পরগনার সিএমএইচও ডা. সমুদ্র সেনগুপ্ত গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অতীতেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, “যদি তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্বাস্থ্য দপ্তরের এক আধিকারিক জানান, “স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের অপব্যবহার আমরা বরদাস্ত করবো না। প্রকৃত উপকারভোগীরা যেন সঠিক পরিষেবা পান, তা নিশ্চিত করতেই হবে।”
স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের অপব্যবহার কতটা প্রকট?
এটাই প্রথম নয়, এর আগেও স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কোনো রোগীর অপ্রয়োজনীয় অপারেশন, ভুল বিলিং, কিংবা মিথ্যা মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখিয়ে টাকা তোলা — এমন ঘটনায় রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বারবার ভেঙে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটির স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বজায় রাখতে হলে ডিজিটাল নজরদারি এবং কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি।
“স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ রোধে নজরদারি আরও কড়া করতে হবে”—স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে?
এই ঘটনার জেরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর মানুষ কতটা ভরসা রাখতে পারবে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষের জন্য প্রকল্প চালু করা হয়েছে, অন্যদিকে এর অপব্যবহারে প্রকল্পই প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
বিশ্বজিৎ দাসের পরিবার বর্তমানে আরেকটি অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা আবার খরচসাপেক্ষ। তারা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন, প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
হার্নিয়ার রোগী হয়েও অ্যাপেনডিক্স কেটে ফেলার মতো ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির নয় — এটি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার বড় প্রশ্ন। তদন্ত এখনো চলমান, তবে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া জরুরি।
প্রশ্ন রয়ে যায়, সরকারি প্রকল্পের এমন অপব্যবহার বন্ধ করতে আরও কতটা কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে রাজ্য সরকারকে?
এম আর এম – ০১৫৫, Signalbd.com