বাংলাদেশিকে গুলি করে মরদেহ নিয়ে গেল বিএসএফ

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঝাঁঝাডাঙ্গা সীমান্তে ভারতের বিএসএফ-এর গুলিতে এক বাংলাদেশি কৃষক নিহত হয়েছেন। নিহতের মরদেহ ভারতে নিয়ে গেছে বিএসএফ সদস্যরা। বিজিবি ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে।
সীমান্তে গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবক
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঝাঁঝাডাঙ্গা সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে ইব্রাহিম বাবু (৩২) নামের এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। বুধবার (২ জুলাই) দুপুরে সীমান্তের ৭৯ নম্বর মেইন পিলারের নিকটবর্তী গালার মাঠ এলাকায় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
“আমার ছেলে কৃষিকাজ করতো, সে কোনো চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল না”—নিহত বাবুর পিতা নুর ইসলাম।
নিহত বাবু ঝাঁঝাডাঙ্গা গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে। ঘটনার পর তার মরদেহ ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যায় বিএসএফ সদস্যরা।
কীভাবে ঘটল এই গুলিবর্ষণের ঘটনা?
নিহতের পরিবার জানায়, দুপুরে বাবুসহ ৪–৫ জন কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে সীমান্তঘেঁষা গালার মাঠে গিয়েছিলেন। অসাবধানতাবশত তারা সীমান্তের ৭৯ নম্বর মেইন পিলার পার হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন। এ সময় ভারতীয় ৩২ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের হালদারপাড়া ক্যাম্পের সদস্যরা সরাসরি ২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে, যার মধ্যে একটি গুলি বাবুর শরীরে লাগে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
স্থানীয়রা জানান, গুলিবর্ষণের পর বিএসএফ সদস্যরা তড়িঘড়ি করে বাবুর মরদেহ তুলে নিয়ে যায় এবং ভারতের কৃষ্ণগঞ্জ থানার শক্তিনগর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বিজিবির বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) চুয়াডাঙ্গা-৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হাসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, “বিএসএফ একদল চোরাকারবারির ওপর গুলিবর্ষণ করেছে বলে জানিয়েছে। এতে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ঘটনাস্থল ভারতীয় ভূখণ্ডে হলেও নিহত ব্যক্তি বাংলাদেশি কৃষক।”
ঘটনার পরপরই বিজিবি ভারতের বিএসএফ-এর সঙ্গে জরুরি পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে। বিজিবির পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মরদেহ দ্রুত ফেরতের দাবি জানানো হয়েছে।
পরিবার ও এলাকাবাসীর ক্ষোভ
নিহত বাবুর বাবা নুর ইসলাম জানান, “আমার ছেলে কখনোই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে কৃষিকাজ করেই সংসার চালাতো। সীমান্তে শুধু ঘাস কাটতে গিয়েছিল, কোনো বেআইনি কাজ করেনি।”
এলাকাবাসী বলেন, সীমান্তে এমন গুলির ঘটনা বারবার ঘটছে অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো স্থায়ী সমাধান নেওয়া হচ্ছে না। তারা সীমান্তে নিরাপত্তা ও নজরদারির জোর দাবি জানিয়েছেন।
অতীতেও ঘটেছে এমন ঘটনা
এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগেও চুয়াডাঙ্গা, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। শুধু চলতি বছরেই ৬ জনের বেশি বাংলাদেশি বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি।
সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষরা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। কখনো গরু আনতে গিয়ে, কখনো ঘাস কাটতে গিয়ে, কখনোবা অনিচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত পার হলে গুলির মুখে পড়ছেন।
আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার প্রশ্নে উদ্বেগ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত হত্যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করার অধিকার কোনো দেশের নেই।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা সীমান্তে প্রাণঘাতী নয়, বরং নন-লিথাল পদ্ধতি গ্রহণ করে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং দ্রুত পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। তবে এলাকাবাসীর আশঙ্কা, পতাকা বৈঠকের পরও হয়তো বিচার বা প্রতিকার মিলবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশিদের মৃত্যুর ঘটনায় কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ না নিলে এমন ঘটনা বাড়তেই থাকবে।”
বাংলাদেশ সরকার যদি সীমান্ত হত্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং যৌথ নজরদারির ব্যবস্থা জোরদার করে, তবে হয়তো কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসতে পারে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—‘আর কত প্রাণ গেলে তবে সীমান্তে শান্তি ফিরবে?’
এম আর এম – ০১৪৪, Signalbd.com