সবাই ভেবেছিলেন ঘুমোচ্ছেন, আদতে চিরঘুমে রিকশাচালক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাস সংলগ্ন এলাকায় নিজ রিকশায় নিথর হয়ে বসেছিলেন এক রিকশাচালক। পথচারীরা প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি ঘুমাচ্ছেন। পরে জানা যায়, তিনি চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি নাড়া দিয়েছে সবার মনে।
রিকশায় বসেই নিথর দেহ
আজ মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন ডাস এলাকায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। যাত্রী ছাউনির পাশে নিজের রিকশায় বসা এক রিকশাচালককে প্রথমে ঘুমন্ত বলে ভেবেছিলেন পথচারীরা। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকায় সন্দেহ হয় দুইজন তরুণ-তরুণীর। তারা যখন এগিয়ে এসে স্পর্শ করেন, তখনই আবিষ্কার করেন—তিনি আর জীবিত নেই।
ঘটনাটি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। উপস্থিত মানুষ আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েন।
পথচারীদের চোখে ধরা পড়ে মৃত্যুর আলামত
প্রত্যক্ষদর্শী দুইজন পথচারী জানান, বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে তারা প্রথম ওই রিকশাচালককে ঘুমন্ত ভেবে পাশ কাটিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরে তারা যখন আবার একই পথে ফিরে আসেন, তখনো রিকশাচালককে ঠিক আগের মতোই বসে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়।
তাদের একজন জানান, “আমরা ভাবলাম, হয়তো খুব ক্লান্ত, তাই একটু ঘুমিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কিছুটা সময় পেরিয়ে একইভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যাই। তখন হাত ধরতেই ঠান্ডা লেগে যায়।”
পরিচয় মেলেনি, লাশের দায়িত্বে পুলিশ
পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে শাহবাগ থানার পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম। পুলিশ জানায়, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, “আমাদের ফোর্স দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তবে এখন পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। সম্ভবত স্ট্রোক করেই ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেছেন।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ যৌথভাবে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ঘটনা, প্রতিবাদে সরব নেটিজেনরা
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেত্রী মানসুরা আলম তার ফেসবুক প্রোফাইলে এ ঘটনা নিয়ে একটি আবেগঘন পোস্ট করেন। তিনি লেখেন, “সবার ভাবনা ছিল, তিনি ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু আদতে তিনি চিরঘুমে চলে গেছেন। কতটা কষ্টে মানুষ এই শহরে দিনযাপন করে—এই দৃশ্য তার প্রমাণ।”
অনেকেই এই ঘটনাকে শহরের অমানবিক চেহারার প্রতীক হিসেবে দেখছেন। কেউ বলছেন, “একজন মানুষ, রাস্তায় বসে প্রাণ হারিয়েছেন, অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা কেউ বুঝতেই পারেনি—এটা কি আমাদের সমাজের ব্যর্থতা নয়?”
রিকশাচালকদের জীবনের ঝুঁকি ও দুঃখের প্রতিচ্ছবি
ঢাকা শহরের প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য—রিকশাচালকরা কাঁধে বোঝা টেনে চলেন জীবিকার আশায়। অপ্রতুল বিশ্রাম, নিম্নমানের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবার অভাব—এসব মিলিয়ে তাদের জীবন অনেকটাই অনিরাপদ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যু রিকশাচালকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহ দিকটি সামনে নিয়ে আসে। একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেন, “প্রতিদিন যারা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন, তাদের জীবন কতটা অনিরাপদ, এই ঘটনাই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।”
অতীতেও এমন ঘটনা: একা মৃত্যু, জনসমক্ষে নিঃশব্দ বিদায়
এটাই প্রথম নয়। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অতীতেও দেখা গেছে—রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে ঘুমন্ত মনে করে এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা। কিন্তু পরে জানা গেছে, তারা চিরতরে বিদায় নিয়েছেন।
২০২৩ সালে মোহাম্মদপুর এলাকায় এক ভ্যানচালক একইভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় অনেকে ভেবেছিলেন তিনি মাতাল বা ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সমাজের দায়িত্ব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রশাসনের নয়, নাগরিকদেরও মানবিক দায় রয়েছে। অজ্ঞান বা নিথর কাউকে রাস্তায় দেখলে সহানুভূতির চোখে দেখা এবং প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নেয়া জরুরি।
ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন একটি নিঃশব্দ মৃত্যু আমাদের সমাজের চিত্রকে আরও পরিষ্কার করে তুলল। তিনি কে ছিলেন, কী ছিল তার জীবন, সেসব হয়তো জানা যাবে না। তবে তার এই মৃত্যু যেন সমাজের চোখ খুলে দেয়।এম আর এম – ০১৩৩, Signalbd.com