হোটেলে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের লাশ: প্রশ্ন অনেক, উত্তর খুঁজছে পুলিশ

ঢাকার মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে এক প্রবাসী পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুতে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বিষক্রিয়ার আশঙ্কা করলেও পুলিশ এখনো নিশ্চিত নয়—খাদ্যে বিষ ছিল নাকি এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তদন্তে উঠে আসছে নানা রহস্য, বিশ্লেষণ করা হচ্ছে ফোনালাপ, সিসিটিভি ফুটেজ ও সম্পর্কিতদের ভূমিকা।
হোটেল কক্ষে এক পরিবারের মৃত্যু: রাজধানীতে চাঞ্চল্য
রাজধানীর মগবাজারের সুইট স্লিপ নামের একটি আবাসিক হোটেলে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শনিবার রাতে ঢাকায় পৌঁছে হোটেলে উঠলেও পরদিন রোববার সকালেই তিনজনই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে মারা যান। এই ঘটনায় স্বজনদের পাশাপাশি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও রহস্য উদঘাটনে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।
কে এই মনির হোসেন?
মৃত স্বামীর নাম মনির হোসেন (৪৫)। তিনি প্রায় ৩০ বছর সৌদি আরবে প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফেরেন। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার দেহলা গ্রামের বাসিন্দা মনির প্রবাসে ঠিকাদারি করে বিপুল সম্পদের মালিক হন। ঢাকায় কেরানীগঞ্জে দুটি বাড়ি, বাস মালিকানা ও গ্রামে জমিজমাসহ রয়েছে ব্যাপক সম্পত্তি। মনিরের স্ত্রী স্বপ্না আক্তার (৩৬) এবং ছেলে নাঈম হোসেন (১৭) — দুজনই তার সঙ্গেই ছিলেন। ছেলেটি শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিল এবং তার চিকিৎসার উদ্দেশ্যেই ঢাকায় এসেছিলেন তারা।
ঘটনার দিন কী ঘটেছিল?
শনিবার বিকেলে মনির পরিবার নিয়ে ঢাকায় আসে এবং মগবাজারের ওই হোটেলে ওঠে। সূত্র বলছে, রাত আটটার দিকে মনিরের ঘনিষ্ঠজন রফিকুল ইসলাম হোটেলে এসে তাদের জন্য খাবার নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর মনির ফোন পেয়ে হোটেল থেকে বের হন। এক ঘণ্টা পর পানি ও খাবার নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। রাতেই তিনজনই বমি করতে থাকেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন।
পরদিন সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে মনির রফিকুলকে ফোন করে দ্রুত হোটেলে আসতে বলেন। এরপর এক ফার্মেসির কর্মচারী ও রফিকুলের মেয়ে এসে ওষুধ দেন, কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে বেলা ১১টার পর স্বপ্না ও নাঈমকে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে মনিরকেও হাসপাতালে নেওয়া হয়, তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তিনজনই প্রাণ হারান।
বিষক্রিয়া নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা—ঘটনাটি বিষক্রিয়াজনিত হতে পারে। তবে সাধারণ ফুড পয়জনিং হলে তিনজনের মৃত্যুর সময় এতটা কাছাকাছি হওয়ার কথা নয়। তদন্তকারীরা সন্দেহ করছেন, খাবারে বিষ মেশানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কারা এবং কেন এটি করেছে—তা এখনো স্পষ্ট নয়।
রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, “আমরা ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। হোটেল ও আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মনিরের ফোনালাপ ও সম্পত্তির বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সম্পত্তির জটিলতা ও পারিবারিক টানাপোড়েন
তদন্তে উঠে এসেছে, দেশে মনিরের বিপুল সম্পদ ছিল যার দেখভাল করতেন তার দূর সম্পর্কের চাচা রফিকুল। মনির সৌদি আরব থেকে এক কোটি টাকা সরাসরি তার ব্যাংক একাউন্টে পাঠিয়েছিলেন বাড়ি কেনার জন্য। শুধু তাই নয়, রফিকুল ও তার মেয়েই মনিরদের অসুস্থ অবস্থায় প্রথম হোটেলে আসে। পুলিশের সন্দেহ—এই সম্পর্কেই কী লুকিয়ে আছে ঘটনার সূত্র?
হোটেল কর্তৃপক্ষ জানাল কী?
হোটেল সুইট স্লিপ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মনির পরিবার ছাড়া হোটেলে থাকা অন্য কোনো অতিথির এমন শারীরিক সমস্যা হয়নি। খাবার যদি হোটেল থেকেই নেওয়া হয়ে থাকে, তবে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। তারা পুরোপুরি সহযোগিতা করছে পুলিশের সঙ্গে এবং সিসিটিভি ফুটেজ সরবরাহ করেছে।
আইনি প্রক্রিয়া ও তদন্তের অগ্রগতি
রোববারই তিনটি মরদেহ পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় এবং পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। এখনো কোনো মামলা হয়নি, তবে পুলিশ জানায়, এটি প্রক্রিয়াধীন। রফিকুল, তার মেয়ে ও মেয়ের স্বামীকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রফিকুল বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে আছেন।
রমনা থানার ওসি গোলাম ফারুক বলেন, “আমরা দুটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করছি—একটি হল স্বাভাবিক বিষক্রিয়া, অন্যটি হল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড। তবে ময়নাতদন্ত ও পূর্ণ তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।”
রহস্য কী বলছে?
তিনজনের মৃত্যু, তাও একসাথে—তা স্বাভাবিক কোনো বিষক্রিয়া হলে এমনভাবে ঘটার সম্ভাবনা কম। উপরন্তু, একজন ফোন পেয়ে বের হওয়া, ঘন্টা পর ফিরে এসে খাবার আনা, এবং সেই খাবারের পর সবার অসুস্থ হওয়া—এই বিষয়গুলো তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে। পরিবার ও সম্পদের জটিলতাও এ ঘটনায় কোনোভাবে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
“খাদ্যে বিষক্রিয়া হলেও এমন একসাথে মৃত্যু অস্বাভাবিক”—রমনা থানার তদন্ত কর্মকর্তা।
শেষ কথা
এই রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় পুরো দেশজুড়ে শোক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। এটি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি নিখুঁতভাবে সাজানো হত্যাকাণ্ড—তার উত্তর দিতে পারবে শুধুই তদন্ত রিপোর্ট। তবে প্রশ্ন একটাই—কীভাবে হোটেলের সুরক্ষিত কক্ষে ঘটে গেল এমন মর্মান্তিক ঘটনা?
এম আর এম – ০১১৯, Signalbd.com