গাজীপুরে চুরির অপবাদ দিয়ে শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ১

চুরির অপবাদে রশি দিয়ে বেঁধে নির্মম নির্যাতনের শিকার তরুণ শ্রমিক হৃদয়। ভিডিও ভাইরাল হতেই উত্তাল গাজীপুর। গ্রেফতার হয়েছে এক সহকর্মী, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চুরির অপবাদ দিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে ১৯ বছরের এক তরুণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। নিহত যুবক মো. হৃদয় টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার বাসিন্দা। ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, এবং কারখানা কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
কারখানার ভেতরেই ভয়াবহ নির্যাতন
গত ২৭ জুন, শুক্রবার রাতে গ্রীনল্যান্ড লিমিটেড নামের ওই পোশাক কারখানায় হৃদয় নামের ওই শ্রমিককে চুরির অভিযোগে একটি কক্ষে রশি দিয়ে বেঁধে মারধর করা হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, হৃদয়কে জানালার গ্রিলের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, তার মুখ ও নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, পিঠ বাঁকা করে হাত ও পা রশিতে বাধা, আশেপাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে মারধর করছে।
একপর্যায়ে হৃদয় অচেতন হয়ে পড়লেও নির্যাতন থামেনি। তাকে টেনেহিঁচড়ে কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, কেউ একজন বলছিল, “এত পিটানোর পরও কিছু হয়নি!”
নিহত হৃদয়ের পরিচয় ও পারিবারিক অবস্থা
নিহত হৃদয় (১৯) টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শুকতার বাইদ গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। তিনি গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ভাড়া বাসায় মা ও বোনের সঙ্গে থাকতেন। গ্রীনল্যান্ড লিমিটেডে অস্থায়ীভাবে ইলেকট্রিক মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন।
ঘটনার দিন রাতে কাজ শেষে বাসায় না ফেরায় তার বড় ভাই লিটন মিয়া ও মা কারখানায় যান। সেখানে গিয়েই জানতে পারেন, শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছে এবং হৃদয়ের মরদেহ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ভাইয়ের অভিযোগ ও পুলিশের অভিযান
হৃদয়ের বড় ভাই লিটন মিয়া জানান, “আমার ভাইকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ লুকাতে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। আমরা বিচার চাই।”
এ ঘটনায় ২৮ জুন গভীর রাতে কোনাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় কারও নাম উল্লেখ না থাকলেও পরদিন হাসান মাহমুদ ওরফে মিঠুন (২৮) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি একই কারখানার শ্রমিক।
কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন জানান, “আমরা সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও প্রমাণ ও স্থানীয়দের সাক্ষ্যে নিশ্চিত হয়েছি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। একজনকে গ্রেপ্তার করেছি, অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে।”
ভিডিও ভাইরাল ও শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই গাজীপুরের পোশাকশিল্প এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শনিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন গার্মেন্টসের অন্তত ৫০০ শ্রমিক মহাসড়কে নেমে আসে। তারা হত্যার প্রতিবাদে গ্রীনল্যান্ড গার্মেন্টসের সামনে অবস্থান নেয় এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে সড়ক অবরোধ করে।
পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
কারখানা কর্তৃপক্ষ দ্রুততার সাথে একটি নোটিশ টানিয়ে জানিয়ে দেয়, প্রতিষ্ঠানটি ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ’। যদিও পরে শিল্প পুলিশ জানায়, প্রতিষ্ঠানটি দুই দিনের ছুটিতে রয়েছে, শিগগিরই পুনরায় চালু হতে পারে।
কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা
প্রথমে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করে, “একজন চোর দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশের সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে।” পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সেই ব্যক্তি মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে।
এরপরেই পুলিশের সন্দেহ হয় এবং তদন্তে নামে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট হয়, এটি দুর্ঘটনা নয় বরং একটি বর্বর হত্যাকাণ্ড।
এদিকে, নিহত হৃদয়ের পরিবার ও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, “কর্তৃপক্ষ ঘটনা গোপন করার চেষ্টা করেছে, যাতে দায় এড়ানো যায়।”
জনমনে উত্তেজনা
বর্তমানে গাজীপুর মহানগরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাটি নিয়ে গভীর তদন্তে নেমেছে। এরই মধ্যে একাধিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে, যার ভিত্তিতে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক।
“আমার ভাই কোনো চোর না। তাকে হত্যা করা হয়েছে — আমরা বিচার চাই”—লিটন মিয়া, নিহত হৃদয়ের বড় ভাই।
গাজীপুরে শ্রমিক হৃদয়কে চুরির অভিযোগে যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে, তা শুধু নির্মম নয়, একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে কারখানার নিরাপত্তা ও মানবাধিকার বিষয়ে।
এই ঘটনা দেশজুড়ে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসনের দায়িত্ব এখন দ্রুত তদন্ত শেষ করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন নয় — এটি বৃহৎ শিল্প খাতের ‘অদৃশ্য সিস্টেমিক নির্যাতনের’ একটি উদাহরণ মাত্র। এখন দেখার বিষয়, আদৌ কি এই ঘটনার সুবিচার হবে?
এম আর এম – ০১০৯, Signalbd.com