আঞ্চলিক

বুয়েটের তৈরি রিকশা শুরুতে চলবে পল্টন, ধানমন্ডি ও উত্তরায়

ঢাকার ব্যস্ত সড়কে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রিকশার ভূমিকা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘদিন ধরেই চলাচলে অনিয়ম, অনুমোদনহীনতা এবং নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি নিয়ে রিকশাচালক ও যাত্রী উভয়েই চাপে রয়েছেন। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এবার আধুনিক, পরিকল্পিত এবং নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) উদ্ভাবিত ব্যাটারিচালিত রিকশা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে ঢাকার তিনটি এলাকায়—পল্টন, ধানমন্ডি ও উত্তরা।

এই রিকশাগুলো কেবল নির্ধারিত এলাকা ও নির্ধারিত সড়কে চালানোর অনুমতি পাবে। চালকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে লাইসেন্স গ্রহণের পর রিকশা কিনে চালাতে পারবেন। নতুন এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজধানীতে অনুমোদিত ও নিরাপদ রিকশাচালনার সূচনা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রশিক্ষণেই সূচনা, রিকশাচালকদের জন্য তৈরি হচ্ছে ৩০০ প্রশিক্ষক

শনিবার (২৮ জুন) দুপুরে গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে প্রশিক্ষক (মাস্টার ট্রেইনার) তৈরির কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। তিনি জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০০ প্রশিক্ষক তৈরি করা হচ্ছে, যাঁদের মাধ্যমে রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ২০০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে তিনদিনের এই কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে নির্বাচিতদের মধ্যে বেশিরভাগই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই উদ্যোগে তরুণদের সম্পৃক্ত করার কারণ হিসেবে আসিফ মাহমুদ বলেন, “যাঁরা সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাঁরাই সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে উপযুক্ত। তাঁরা রিকশাচালকদের সহায়ক হিসেবে কাজ করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে একটি নতুন যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবেন।”

রিকশাচালকদের অবদানের স্বীকৃতি ও নাগরিক অধিকার

অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ রিকশাচালকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রিকশাচালকেরা আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন, গুলির মুখেও তাঁরা পিছু হটেননি। এ দেশের গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পক্ষে তাঁদের এই ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। এই নতুন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালনার উদ্যোগ তাঁদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এক বাস্তব পদক্ষেপ।”

তিনি আরও জানান, নতুন অনুমোদিত রিকশা চালকরা নির্ধারিত সড়কে সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে চলাচল করতে পারবেন। কোনো পুলিশি হয়রানি বা অবৈধ ঘুষ দাবির মুখোমুখি হবেন না।

অনুমোদিত রিকশা: ধাপে ধাপে রূপান্তর, জোরজবরদস্তি নয়

অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, নতুন রিকশা ব্যবস্থায় রূপান্তর ধাপে ধাপে হবে। যেসব রিকশা বর্তমানে অনুমোদিত নয়, সেগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলা হবে, তবে কোনো প্রকার জোরজবরদস্তি করা হবে না। তিনি বলেন, “যাঁরা রিকশা চালাচ্ছেন, তাঁরাই এই নতুন ব্যবস্থায় অগ্রাধিকার পাবেন। অনুমোদিত রিকশা চালাতে ইচ্ছুক চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স দেওয়া হবে।”

এছাড়া অনুমোদিত রিকশাগুলোর চার্জিং পয়েন্ট স্থাপন নিয়ে কাজ চলছে। একটি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব চার্জিং অবকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে বলে জানান প্রশাসক।

আগস্ট থেকে চালু হবে নতুন রিকশা, দাম দুই লাখ টাকার নিচে

প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ আরও বলেন, নতুন রিকশাগুলো আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাজারে ছাড়া হতে পারে। এর দাম দুই লাখ টাকার নিচে রাখা হবে যাতে চালকরা সহজেই কিনতে পারেন। সরকার নতুন এই যানবাহন ব্যবস্থাকে একটি স্থায়ী, নিরাপদ ও আধুনিক শহুরে পরিবহনে রূপ দিতে চায়।

এই ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি টিম নকশা করেছে। বুয়েটের গবেষকদের দাবি, এসব রিকশা শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তা ও আরাম নিশ্চিত করবে।

বিদ্যমান রিকশা ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনায় হতাহত

অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ বলেন, “আমাদের শহর ও গ্রামে আজ লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে—যেগুলোর না আছে কোনো নকশা, না আছে মানসম্পন্ন স্পেসিফিকেশন। চালকরাও প্রায়ই জানেন না কীভাবে সঠিকভাবে এগুলো চালাতে হয়। এসব অনিয়ম রোধ করতেই এই নতুন পরিকল্পনা।”

তিনি বলেন, “অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। তাই নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও স্ট্যান্ডার্ড রিকশা চালনার মাধ্যমেই দুর্ঘটনার হার কমানো সম্ভব।”

৫৩ লাখ টাকায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, ব্র্যাকের সহায়তা

প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বাস্তবায়নে অংশ নিচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রাম। এই প্রশিক্ষণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রশিক্ষক তৈরির মাধ্যমে সারা দেশে নিরাপদ ও পরিকল্পিত রিকশাচালনার সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সরকার।

উপসংহার: ঢাকায় রিকশা ব্যবস্থার আধুনিকায়নের নতুন অধ্যায়

বুয়েট উদ্ভাবিত ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করছে। এটি শুধু যানজট বা দূষণ কমাবে না, বরং সমাজে অবহেলিত রিকশাচালক শ্রেণির প্রতি ন্যায়বিচার ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পকে সফল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নির্ধারিত এলাকাগুলোতে নতুন রিকশাগুলো সফলভাবে চালু হলে, ভবিষ্যতে রাজধানীর অন্যান্য অঞ্চল এবং দেশের অন্যান্য শহরেও এই মডেল চালু করা হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button