আঞ্চলিক

শুল্কায়ন জটিলতায় বন্দরে আটকে আছে আধুনিক সেচযন্ত্র

বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকায়নের প্রয়াসে সেচব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ধাপ। এই লক্ষ্যেই দেশের উত্তরাঞ্চলে ভূ-উপরিস্থ পানি কাজে লাগিয়ে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। তবে আধুনিক সেচযন্ত্র আমদানিতে শুল্কায়ন জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের বাধা। চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেন্টার পিভট ইরিগেশন (সিপিআই) সিস্টেম – যা দেশের কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

শনিবার (২৮ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন শেরপা পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু তাহের। প্রতিষ্ঠানটি বিএডিসি’র কৃষি সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদার হিসেবে অস্ট্রিয়া থেকে সিপিআই সিস্টেম আমদানি করেছে।

কৃষি যন্ত্রাংশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা

সংবাদ সম্মেলনে আবু তাহের অভিযোগ করেন, কাস্টমস বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কৃষিযন্ত্রের প্রযুক্তিগত ধারণার অভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ সেচব্যবস্থাকে খণ্ডিত করে শুল্কায়ন করতে চাওয়া হচ্ছে, যা পুরো ব্যবস্থাটিকেই অকার্যকর করে তুলতে পারে।

তিনি বলেন, “সিপিআই একটি সমন্বিত সেচব্যবস্থা যেখানে একাধিক যন্ত্রাংশ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৫ টন ওজনের পাইপ, পানি বিতরণকারী যন্ত্রাংশ এবং কন্ট্রোল সিস্টেম রয়েছে। একটি উপাদান বাদ দিলে পুরো ব্যবস্থা কাজ করবে না। কিন্তু কাস্টমস বিভাগ পুরো সিস্টেমকে একক ইউনিট হিসেবে না মেনে, খণ্ড খণ্ড যন্ত্রাংশ হিসেবে গণ্য করছে। এতে শুল্ক অনেক গুণ বেড়ে গেছে।”

তিনি আরও জানান, ১৭ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্কায়নের জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়া হলেও এখনো ছাড়পত্র মেলেনি। সিপিআই সিস্টেমের জন্য প্রাথমিকভাবে ধার্য শুল্ক ছিল প্রায় ১২ লাখ টাকা। কিন্তু এখন সেটিকে বাণিজ্যিক উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রায় ৪২ লাখ টাকা শুল্ক ও জরিমানা দাবি করা হচ্ছে। এছাড়া বন্দরে পড়ে থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতি মাসে প্রায় ৪ লাখ টাকার ক্ষতি গুণতে হচ্ছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ঝুঁকিতে পড়েছে সময় ও অর্থ

শেরপা ইঞ্জিনিয়ারিং জানায়, সিপিআই ব্যবস্থাটি উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলায়—পাবনা, নাটোর এবং সিরাজগঞ্জে—সেচ উন্নয়নে ব্যবহৃত হওয়ার কথা। দেশের দ্রুত মরুকরণ রোধে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বিএডিসি’র উদ্যোগে ভূ-উপরিস্থ পানিকে কাজে লাগিয়ে প্রথমবারের মতো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই উদ্যোগের আওতায় শেরপা ইঞ্জিনিয়ারিং অস্ট্রিয়ার একজন আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রটি আমদানি করেছে। এর মাধ্যমে অনাবৃষ্টির সময়েও কৃষকদের পর্যাপ্ত সেচ সরবরাহ করা সম্ভব হতো, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকায়।

কিন্তু কাস্টমস জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক ধীরগতির কারণে এখন সেই যন্ত্র বন্দরে আটকে থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষকরাও।

প্রযুক্তির গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সিপিআই ব্যবস্থাটি মূলত আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এক ধরনের ঘূর্ণনভিত্তিক সেচব্যবস্থা। এতে কম পানিতে অধিক পরিমাণ জমি সেচ দেওয়া সম্ভব। এটি কম সময় ও শ্রমে কৃষিকাজে ব্যাপক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বহু দেশে এই প্রযুক্তি ইতোমধ্যে ব্যবহার হয়ে আসছে।

এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি দেশের কৃষিতে ব্যবহারের জন্য যখন হাতে এসেছে, তখন তা বন্দরে আটকে থেকে বিনা প্রয়োজনে নষ্ট হচ্ছে। প্রযুক্তিটি সময়মতো স্থাপন না হলে তার কার্যকারিতা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমদানি নীতিমালায় সংস্কারের দাবি

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বর্তমান আমদানি প্রক্রিয়াকে কৃষিবান্ধব করার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, কৃষি ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট আমদানি প্রক্রিয়ায় যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। কৃষির জন্য যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, সেগুলো আমদানি ও শুল্কায়নে দ্রুততা ও সহজীকরণ প্রয়োজন।

উপব্যবস্থাপক রুহুল আমিন এবং প্রকল্প কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান জানান, তারা ইতোমধ্যে কাস্টমস ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু এখনো কার্যকর কোনো সমাধান আসেনি। তারা অনুরোধ করেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।

সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি

বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির বিষয় নয়, বরং এটি জাতীয় কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষিকে আধুনিকীকরণ করতে হলে এরকম প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রপাতি সহজে এবং দ্রুততার সঙ্গে আমদানি ও ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

কৃষি খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচিত হবে—এ ধরনের আমদানি ও শুল্ক সংক্রান্ত নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় প্রকল্পগুলোতে একই সমস্যায় পড়তে হবে।

উপসংহার

একটি সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তি শুল্কায়ন জটিলতার কারণে আজ কার্যকর হতে পারছে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও। সরকার যদি সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে দেশের কৃষিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button