রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যরা!

রাজধানী ঢাকা এখন নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে। চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। গত আট মাসে রাজধানীতে সংঘটিত ৪৭টি ডাকাতির ঘটনায় ৩৬ জনের নাম উঠে এসেছে, যাদের মধ্যে ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডাকাতি করার সময় এই দুষ্কৃতকারীরা র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পোশাক পরে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ ও মূল্যবান মালামাল লুট করছে।
রাজধানীতে র্যাবের পোশাক পরে ছিনতাই: সাধারণ মানুষের উপর ভরসাহীনতার ছায়া
গত ১৪ জুন উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১২ ও ১৩ নম্বর সড়কের সংযোগস্থলে ঘটে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। র্যাবের পোশাক পরে দুই পরিবেশকের কর্মীদের গতিরোধের চেষ্টা করে ডাকাতরা। র্যাব ভেবে দৌড়ে পালাতে যাওয়া দুইজনকে ধরে প্রায় এক কোটি ৮ লাখ টাকা ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় দুষ্কৃতকারীরা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে পুলিশ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। এই ডাকাতির নেতৃত্ব দিয়েছিল চাকরিচ্যুত পুলিশ ও সেনা সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক সদস্যদের জড়িততা: ডাকাতির জাল
২০১৯ সালের মার্চে ধানমন্ডির একটি বাসায় যৌথ বাহিনীর ছদ্মবেশে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করা হয়। মামলা অনুসারে জড়িত ছিল সাবেক ও বর্তমান ১১ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন গ্রেফতার হয়েছে, বাকিরা এখনও পলাতক। উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া মালামাল।
অন্যদিকে, গত জানুয়ারিতেও গুলশানে একইভাবে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ৬ জন সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও একমাত্র একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার হয়নি কোনো মালামাল।
২০২২ সালের অক্টোবরেও মোহাম্মদপুরে ৭০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৭৫ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে, যেখানে ১১ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য জড়িত ছিল, কিন্তু মাত্র ৫ জনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার মাত্র ১৭ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগীদের ভয়-অনুভূতি: সত্য বলতে পারেন না কেউ
ধানমন্ডি থানায় ডাকাতি মামলার বাদী তৌহিদুল ইসলাম লিমন জানিয়েছেন, “আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ নয়, পুলিশ, ডিজিএফআই ও আর্মির লোকও রয়েছে। মামলা করার পর থেকেই আমরা ভয়ে আছি। টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবার অবস্থা নেই।”
অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হোন, পরামর্শ সমাজ বিশ্লেষকের
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানেই তারা চাকরি করুক না কেন, কোনরকম সুযোগ-সুবিধা চলমান থাকা উচিত না। অবসরকালীন পাওয়া সব সুবিধা বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে পাঠানো উচিত।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ৪৭টি ডাকাতির ঘটনায় ৩৬ জনের নাম
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, আট মাসে রাজধানীতে ৪৭টি ডাকাতির ঘটনার তদন্তে ৩৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও তাদের সোর্সের নাম এসেছে। এর মধ্যে ১৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ডিএমপি মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেছেন, “গ্রেফতার করা হয়েছে বলে আমরা আত্মতুষ্টি করব না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় কী করা উচিত?
ডিএমপির পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক বা পরিচয়ে কেউ অভিযানে এলে অবশ্যই ৯৯৯ অথবা নিকটস্থ থানায় ফোন করে সত্যতা যাচাই করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন প্রতারিত না হয়, এজন্য পুলিশের যথাযথ সতর্কতা জরুরি।
সরকারের করণীয়: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে কড়া পদক্ষেপ প্রয়োজন
এ ধরনের অভিযোগ সমাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এর ফলে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে, এইসব চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ও দখলদারি বন্ধ করতে হবে।
রাজধানীর নিরাপত্তায় শঙ্কাজনক সংকেত, সচেতনতা ও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন
চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বেআইনি কর্মকাণ্ড দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক শান্তির জন্য এক বড় ধরণের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। না হলে, এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ বাড়তে থাকবে, যা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও বিপর্যস্ত করবে।